বিনিয়োগের গতিতে ধরা গিট্টুটা ছাড়ছে না। রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকলেও সেই স্থবির অবস্থাতেই রয়েছে। প্রবৃদ্ধি মূলত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ দ্বারা ধাবিত। বাড়েনি বেসরকারি বিনিয়োগ। আর এটা জিডিপির ২৩ বা ২৪ শতাংশেই আটকে আছে।আবার উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিদেশিদের কাছে থেকে পাওয়া প্রতিশ্রুতির ৪৮.৫৪ বিলিয়ন ডলার অলস পড়ে আছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে দেশে বিনিয়োগ বেড়েছে।অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ৫ বা ৬ শতাংশ থেকে ৭ বা ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) হয়নি। এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে, যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪৭০ কোটি ৮০ লাখ ডলারের সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে। যা আগের বছরের চেয়ে ৩৯ শতাংশ বেশি। নিট এফডিআই এসেছে আরও বেশি ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরে ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলার নিট এফডিআই এসেছে দেশে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩২৩ কোটি ৩০ লাখ (৩.২৩ বিলিয়ন) ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছিল বাংলাদেশ। নিট বিনিয়োগের অঙ্ক ছিল ১২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলার বিদেশি বিনিয়োগ এসেছিল দেশে। এর মধ্যে নিট এফডিআইয়ের পরিমাণ ছিল ২৬৩ কোটি ডলার।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসে ওই বছর। এর মধ্যে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করে জাপান টোব্যাকো। আকিজ গ্রুপের তামাক ব্যবসা কেনা বাবদ প্রায় ১৫০ কোটি (১.৫ বিলিয়ন) ডলার বিনিয়োগ করেছিল তারা। দেশের বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের প্রবৃদ্ধি বেড়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। যা গত সাড়ে ৩ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দাবি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, টানা আট মাস ধরে বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি ১১ শতাংশ ছাড়িয়ে ১১ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশে উঠেছিল। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় ফেব্রুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি কমে ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে নেমে আসে। মার্চে তা দশমিক ৫৭ শতাংশ পয়েন্ট বেড়ে ১১ দশমিক ২৯ শতাংশে ওঠে। সর্বশেষ জুন মাসে তা আরও বেড়ে ১৩ শতাংশ ছাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশে উঠেছে। অন্যদিকে গত ২০২১-২২ অর্থবছরের ৮ হাজার ২৪৯ কোটি ৫০ লাখ (৮২.৪৯ বিলিয়ন) ডলারের বিভিন্ন ধরনের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এই অঙ্ক আগের বছরের চেয়ে ৩৬ শতাংশ বেশি।
আর অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) তথ্য বলছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত আমাদের দেশে বৈদেশিক ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ১৬৯ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলার। এর বিপরীতে অর্থ ছাড় হয়েছে ১১১ দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলার। এখনো পাইপলাইনে পড়ে আছে ৪৮ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলার। সবচেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হচ্ছে বিশ্বব্যাংক থেকে ৩২ শতাংশ, এডিবি থেকে ২৪ শতাংশ, জাপান থেকে ১৮ শতাংশ, চীনের ৮ শতাংশ, রাশিয়ার ৫ শতাংশ, ভারতে ২ শতাংশ, আইডিবি ও এআইআইবির ১ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে ৫ শতাংশ। মোট নেওয়া ঋণের মধ্যে এসডিআরে নেওয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি ৪১ শতাংশ। এরপরই রয়েছে মার্কিন ডলারে ৩২ শতাংশ, জাপানি ইয়েনে ১৮ শতাংশ, ইউরোয় ৩ শতাংশ এবং অন্যান্য মুদ্রায় ৬ শতাংশ।অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রধান সমস্যা হচ্ছে ব্র্যান্ডিং। বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে এখনো আমাদের ব্র্যান্ডিং যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্দরের সমস্যা আছে। এতদিনেও আমাদের বন্দরের অটোমেশন করতে পারিনি। অবকাঠামোতেও সমস্যা রয়েছে। এগুলো ঠিক হলে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগ আসবে। তবে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা একা বিনিয়োগ করে খুবই কম। দেশি বিনিয়োগকারীদের হাত ধরে বিদেশি বিনিয়োগ আসে। সে কারণে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে দেশি বিনিয়োগও বাড়াতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড় বড় শিল্পকারখানা এবং প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যাংক ঋণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এখানেও আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা রয়েছে, আছে দুর্নীতি। দীর্ঘসূত্রতার জন্য প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায়। ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা অহরহ বলা হলেও এখনো বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের অনুমোদন এবং বাস্তবায়নে অসংখ্য সংস্থার কাছে ধরনা দিতে হয়। একজন বিদেশি বিনিয়োগকারী এত দুর্নীতি, তোয়াজ, জটিলতা এবং দীর্ঘসূত্রতায় অভ্যস্ত নয়। তাই বোধ হয় এখনো বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আমাদের জিডিপির এক শতাংশেরও কম।
এছাড়া বিনিয়োগের সুযোগ-সুবিধা যতই বাড়ানো হোক না কেন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিমিত্তে পর্যাপ্ত সঞ্চালন লাইন সংস্থাপন করা না হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রতা জিইয়ে রেখে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। ব্যবসাবান্ধব প্রশাসন গড়ে তোলার জন্য আমলাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের সামর্থ্য অর্জন করতে হবে বলেও যুক্তরাষ্ট্রের সম্প্রতি দেওয়া এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুরের দৃষ্টিতে বিগত কয়েক বছর ধরেই আমাদের বিনিয়োগ একই জায়গায় আটকে আছে। জিডিপির ৩১ থেকে ৩২ শতাংশের মধ্যে। করোনার মধ্যে সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা হলেও বেড়েছিল। তবে বেসরকারি খাতে তেমন বিনিয়োগ হয়নি। এখন সবকিছু অনুকূলে থাকায় সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নে গতি এসেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও নতুন উদ্যমে বিনিয়োগ করছেন। সে কারণেই আমদানি বেড়েছিল। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
বিনিয়োগের ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য তার এক উপস্থাপনায় বলেছেন, রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ৫ বা ৬ শতাংশ থেকে ৭ বা ৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগও (এফডিআই) হয়নি। এফডিআই জিডিপির এক শতাংশের নিচে। যা গতিশীল অর্থনীতির জন্য যথেষ্ট না। রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেশি হলে সেগুলোর সুবিধা নিয়ে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশে সেটা ঘটেনি। সরকার ভৌত অবকাঠামোতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ করছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সেই বরাদ্দ থাকছে না। ২০টি মেগা প্রকল্পের জন্য জিডিপির ২ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হচ্ছে। অথচ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকছে জিডিপির এক শতাংশ। শিক্ষাতেও সমপরিমাণ।
তার মতে, দেশে প্রতিযোগিতাপূর্ণ ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। বিশেষ জায়গা থেকে বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এতে মেধাভিত্তিক ও আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ব্যক্তি বিনিয়োগ বিকশিত হচ্ছে না।