ফসলি জমির মাটি লুটপাট এখন সারা দেশেই চলছে। ফসলের মাঠে মাঠে এখন খননযন্ত্রের বিকট আওয়াজ। শুকনা খেতে এত যন্ত্রের চলাফেরা মানুষ পাঁচ বছর আগেও দেখেনি। কেউ বলছে বড় বড় সেতু আর চার লেনের রাস্তা বানাতে বিনা শুল্কে আনা খননযন্ত্রের উচ্ছিষ্ট এগুলো। ঠিকাদারদের হাত গলে এখন কৃষিজমিতে। ফসলি জমি ‘জবাইয়ের’ এ রকম কত যন্ত্র এখন জমি বধে ব্যস্ত, তার হিসাব কারও কাছে নেই।
সারাদেশের মতই মানিকগঞ্জের সিংগাইরে মাটি কাটার একই চিত্র দেখা যায়। উপজেলার প্রায় সব জমিতেই মাটি খেকোদের কৃষি জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কাটার চিত্র এখন জনসাধারণের নিকট নিত্তনৈমিত্তিক ব্যপার। এখানে অবৈধ ভাবে পুকুর খননের নামে দেদারসে কাটা হচ্ছে কৃষি জমির উপরি ভাগের মাটি। মাটি দস্যুদের দৌরাত্ম্যে এ উপজেলায় আশঙ্কাজনক হারে উর্বরতা হারাচ্ছে ফসলি জমি। এ দস্যুরা দিনের আলোতেই সাবাড় করে দিচ্ছে ফসলি জমির ওপরের অতিগুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ মাটি (টপ সয়েল)।
কৃষিবিজ্ঞান বলছে, যেকোনো ফলনযোগ্য জমির উৎপাদন শক্তি জমা থাকে মাটির ৬ থেকে ১৮ ইঞ্চি গভীরতায়। এটাই টপ সয়েল বা প্রাণমাটি; এলাকাভেদে জৈবিক প্রক্রিয়ায় টপ সয়েল তৈরিতে ১০০ থেকে ৫০০ বছর সময় লেগে যায়। মাটির এই অংশেই ফসল বেড়ে ওঠার গুণাগুণ সুরক্ষিত থাকে। বীজ প্রয়োজনীয় জীবনীশক্তি বা বাঁচার ও বিকাশের উপাদান গ্রহণ করে টপ সয়েল থেকে। এই অংশ একবার কেটে নিলে জমিতে মৃত্তিকা প্রাণ থাকে না। জমি পঙ্গু হয়ে যায়। এমন একটা মূল্যবান মাটির স্তর আমরা শেষ করে দিচ্ছি। দেশের সব কৃষিবিদ–কৃষি কর্মকর্তা বিষয়টি জানেন।
ফসলি উর্বর জমিতে অবৈধ ভেক্যু ব্যবহার করে প্রশাসনের চোখের সামনেই চালাচ্ছে এসব অপকর্ম। ফলে শতশত বিঘা আবাদি জমি পরিনিত হচ্ছে পুকুর, খাল, ডোবা ও নালায়। পাশাপাশি পরিবেশ বির্পযয়ও হচ্ছে। তবে প্রশাসন বলছে, অভিযান চলছে।কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, দিনে অভিযান চললেও মাটি ব্যবসায়ীরা বেছে নিচ্ছেন রাতের আঁধার।এমন অবস্থা চলতে থাকলে কৃষি জমি সংকোচসহ খাদ্য ঘাটতি আশাঙ্কা রয়েছে। আবার এসব উর্বর মাটি পুড়ছে ইট ভাটায়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলার জামশা ইউনিয়নের সারারিয়া কৃষি জমি, দক্ষিণ জামশা, উত্তর জামশা, বলধারা ইউনিয়নের চরমুলবর্গ, মানিকদাহ, বেরুন্ডি, বড়বাকা, চারিগ্রামের দারিয়ার চক, জামির্ত্তার হাতনির চক, খানবানিয়ার চক, গোলাইডাংগার আত্রাইল চক, চান্দহরের সোনাট্যাংরা সহ অধিকাংশ এলাকাতেই চলছে কৃষি জমি কেটে মাটি বিক্রির হিড়িক।এসব ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রির সাথে জড়িত রয়েছে মাটিখেকো খোরশেদ, ইসরাফিল, সফিকুল, ফয়েজ লিয়াকত, বজলু, সাহাবুদ্দিন গংরা।অবৈধ মাহিন্দ্র ট্রাক্টর ও দশ চাকার ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইটভাটায়, ভিটে বাড়িতে। অবৈধ মাহিন্দ্র যানের কারণে নষ্ট হচ্ছে সরকারের কোটি কোটি টাকার পাকা সড়ক। সম্প্রতি এসব অবৈধ যানবাহনে বহনকৃত মাটি পাকা রাস্তায় পড়ে শুষ্ক মৌসুমে ধূলা বালি আর বৃষ্টি বাদলে পড়ে কাদা পানিতে একাকার হয়ে যায়। এতে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে পথচারীদের।
দক্ষিণ জামশার শাহাদাৎ হোসেন নামের এক কৃষক বলেন, যেসব জমি থেকে মাটি কাটছে, তার পাশের জমি এমনিতেই ভেঙে পড়ছে। তাই অনেকে অসহায় হয়ে জমির মাটি দিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
খানবানিয়ার চকের কৃষক আওয়াল হোসেন বলেন, ‘ধানের জমির ওপর দিয়ে মাহিন্দ্রা চলাচলের রাস্তা বানানো হয়েছে। এখান থেকে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য সবাইকে টাকাও দেয় যারা জমি দিতে মানা করে তাদের হুমকি দেয়া হয়। পাশের জমির মাটি কেটে নেওয়ার কারনে আমাদের জমি এমনিতেই ভেঙে পড়বে। জমি না দেয়া ছাড়া আমাদের আর উপায় থাকবে না।’
আত্রাইল চকের কৃষক মুন্নাফ অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, মাটি খেকোরা সবাই ইট ভাটার মালিক। তাদের বাঁধা দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার ৭ শতক কৃষি জমি ছিল। মাটি ব্যবসায়ি সফিকুল চার পাশ থেকে মাটি কেটে ইট ভাটায় বিক্রি করে দিয়েছে। ক্ষেত ভেঙ্গে পড়ায় বাধ্য হয়ে তাকে ক্ষেত দিয়ে দিতে হয়েছে।
জামির্ত্তার ডিগ্রির চরের বাহের বলেন, মাটি ব্যব্যসায়ি ও ইটভাটার মালিকরা কৃষি জমি নষ্ট করলেও কিছুই করার নাই, বললে উল্টো বিপদে পড়তে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কৃষক বলেন, ‘এই মাটি চোরদের বিরুদ্ধে কাদের কাছে নালিশ করব, কোথায় গেলে বিচার পাব? রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ থেকে শুরু করে প্রশাসন, সাংবাদিক সবাই এই মাটি চোরদের দলে যোগ দিয়েছে। টাকার বিনিময়ে বিক্রি হয়ে যায় এরা। গত কয়েকদিন আগে আমার জমির মাটি কাটার বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করতে সাংবাদিকদের খবর দিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু তারা মাটি চোরদের বিরুদ্ধে সংবাদ না করে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে চুপচাপ চলে গিয়েছে।’ কথাগুলো বলতে বলতে এ কৃষক একপর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে যান।
বেরুন্ডি এলাকার কৃষক শহিদুল্লাহ মিয়া জানান, প্রতিদিন কোনো না কোনো কৃষিজমির মাটি নিয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীরা। কৃষিজমির মাটি না দিলে এ বিষয় নিয়ে আতঙ্কে থাকতে হয় আমাদের। স্থানীয় প্রশাসনও তাদের কিছু বলে না। ধানের মৌসুমে জমির মাটি কেটে নিয়ে গর্ত করলে ধান চাষে সমস্যা হবে। তাই কৃষিজমির মাটি লুটের ঘটনার সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
ইউএনও দীপন দেবনাথ বলেন, কৃষি জমির মাটি কাটার নিয়ম নেই। কৃষি জমির মাটি কাটা বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।