শুক্রবার , ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ || ১৫ই চৈত্র, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ - বসন্তকাল || ১৯শে রমজান, ১৪৪৫ হিজরি

মহান মে দিবস: যেমন আছেন সাভারের ট্যানারি শ্রমিকরা

প্রকাশিত হয়েছে-

পহেলা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। শ্রমজীবি মানুষের অধিকার ও দাবী আদায়ের দিন। দিনটি মেহনতি মানুষের বিজয়ের দিন। খেটে খাওয়া মানুষের আনন্দ ও সংহতির দিন এই পহেলা মে।প্রতিবছর পহেলা মে সারা বিশ্বে দিবসটি পালিত হয়। এই দিনটিকে ঘিরে রয়েছে ছুটির ব্যবস্থাও।১২ ঘণ্টার পরিবর্তে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে ১৮৮৬ সালের এই দিন রাস্তায় নামেন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা। আর এই শ্রমিকদের ওপর গুলি চলে। এতে নিহত হন ১১ জন তরতাজা শ্রমিক। তাদের জীবনদানের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বে ৮ ঘণ্টা শ্রমের দাবি মেনে নেওয়া হয়। সেই থেকে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসাবে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস পালিত হয়ে আসছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে।প্রতিবছর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও মে দিবস পালিত হয়। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে দিনটি পালনের আয়োজন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বর্ণাঢ্য র‍্যালী ও আলোচনা সভায় মুখরিত থাকে রাজপথ। এ দিনে সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানের ছুটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।বাংলাদেশের খেটে খাওয়া শ্রমিকদের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে চামড়া শিল্পের সাথে জড়িত ট্যানারি শ্রমিকরা। তাদেরই একাংশের সাথে বিশ্ব শ্রমিক দিবসে শ্রমিকদের অধিকার ও দাবি নিয়ে কথা বলা হয়।এসময় সাভার বিসিক শিল্প নগরীর সালমা ট্যানারি লিমিটেডে কর্মরত নারী শ্রমিক পঞ্চগড়ের রুবি বেগম বলেন, তিনি পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্য। এখানে অনেক বছর কাজ করছেন দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে কিছুটা বেগ পেতে হলেও এই ট্যানারিতে সুযোগ সুবিধা থাকায় খারাপ নেই তিনি। বর্তমানে প্রোডাকশন ভালো হওয়ায় আমদানি ও বেশি হচ্ছে। ট্যানারির কাজ যদি আরও বৃদ্ধি পায় তাদের সুবিধাও বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।আরও কথা হয় নোয়াখালীর বাসিন্দা সোহাগ (২৯) নামের কাটিং পোস্টে কর্মরত আরেকজন শ্রমিকের সাথে। তিনি বেশ কিছু ট্যানারিতে কাটিং পোস্টে কাজ করেন প্রায় ১৫ বছর ধরে। তিনি পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই আছেন। ট্যানারির সুযোগ সুবিধা নিয়ে জানান হাজারীবাগে থাকতে তাদেরকে অনেক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হলেও সাভার বিসিক শিল্প নগরীতে আসার পর সবকিছুই হচ্ছে নিয়ম শৃঙ্খলা মোতাবেক। উপার্জনও বেড়েছে অনেকাংশে। বর্তমানে তাদের কোনো ধরনের শ্রমিক অত্যাচারের শিকার ও হতে হচ্ছে না।এরপর কথা হয় হাইটেক ট্যানারির ম্যানেজার সাগরের সাথে। তিনি বলেন, হাজারীবাগের থেকে সাভার বিসিক শিল্প নগরীতে অনেক সুযোগ সুবিধা থাকলেও শ্রমিকদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় রয়েছে ঘাটতি। এসময় তিনি শ্রমিকদের জন্য শিল্প নগরীর ভিতের হাসপাতাল নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন।প্রসঙ্গত উচ্চ আদালতের এক আদেশের পর পুরান ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্প স্থানান্তর শুরু হয়। এতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা ট্যানারিশ্রমিকরা পড়েছেন বিপাকে। তাদের কেউ কেউ হাজারীবাগ ছেড়ে হেমায়েতপুরেও চলে গেছেন।যদিও নানা কারণে এখনও কয়েক অনেক শ্রমিক হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে এসে কাজ করেন। এতো বড় প্রকল্পে শ্রমিকদের আবাসন সুবিধার কথা থাকলেও এখনো কোনো আবাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আবাসন সুবিধা না পাওয়ায় শ্রমিকদের আয়ের অধিকাংশই চলে যাচ্ছে যাতায়াত ও দুপুরে বিসিক এলাকায় হোটেলের খাবার খরচে।সম্প্রতি সাভারের হেমায়েতপুরের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীতে সরেজমিন গিয়ে বিভিন্ন ট্যানারিতে কাজ করা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।সালমা ট্যানারি ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাখাওয়াতুল্লার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এই শিল্পে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবস্থাপনা ক্রম বিকাশমান ট্যানারি শিল্পে পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত থাকে। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা একটি সমন্বিত, ব্যাপক ও বিস্তৃত ধারণা, যা বর্তমানে সকল পেশাগত ক্ষেত্রেই মেনে চলার চেষ্টা করা হয়। ট্যানারি শিল্পে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যে রয়েছে বিষক্রিয়া, ক্যান্সারসহ ক্ষয়কারক এবং বিপজ্জনক বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য। পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় সালমা ট্যানারি সব সময় বিশেষ ভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকে। আমরা রাসায়নিক পদার্থের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, মজুদকরণ, কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার, রাসায়নিক ঢালার সময় সতর্কতা ইত্যাদি বিষয়ে সতকর্তার সাথে যেনো করে সেই দিকে নজরদারির জন্য আলাদা অভিজ্ঞ লোক রেখেছি।বাংলাদেশ লেবার ফাউন্ডেশন (বি এল এফ) এর উপ-পরিচালক মাহমুদুল হাসান খান জানান, রাসায়নিক পদার্থের ভুল বা অযৌক্তিক ব্যবহার রোগ-ব্যাধি ছাড়াও বিস্ফোরণ এমনকি শ্রমিকদের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘকালীন রাসায়নিক পরিবেশে কাজের ফলে দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়।কারখানার রাসায়নিক ঝুঁকিসমূহ নিরুপণপূর্বক শ্রমিক-কর্মচারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক।ট্যানারি পুলিশ ফাঁড়ির অফিসার ইনচার্জ রাসেল মোল্লা বলেন, বিসিক শিল্প নগরীর সকল ট্যানারি শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য ট্যানারি পুলিশ ফাঁড়ির সকল সদস্যরা ২৪ ঘন্টাই তৎপর থাকে। তাদের যাতে কোনো ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার শিকার হতে না হয় সে দিকটা আমরা বিশেষভাবে নজরদারি রাখি। যেহেতু শিল্প নগরীর ভেতরে বা আশেপাশে কোথায় হাসপাতাল নেই তাই যখনই কোনো শ্রমিক দূর্ঘটনার শিকার হন বা আহত হন আমরা চেষ্টা করি তাদেরকে উদ্ধার করে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে যেতে। এছাড়াও ট্যানরিগুলোতে শ্রমিকদেরকে মালিকপক্ষ থেকে কোনোধরণের অসদাচরণের সম্মুখীন হতে হয় কিনা তাও নজরদারিতে রাখার হয়৷বিসিক শিল্প নগরীর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাফুজুর রহমান রিজোয়ানের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। শ্রমিকদের বিষয় নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখানে সকল পেশায় নিয়োজিত শ্রমিকের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীতকরণ এবং সংরক্ষণডহ কর্ম পরিবেশের কারণে শ্রমিকের স্বাস্থ্যের উপর যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তা প্রতিরোধ করার জন্য আমরা নানা ধরণের নির্দেশনা থেকে শুরু করে সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সহযোগিতা করে থাকি। কর্মক্ষেত্রে সম্ভাব্য সকল স্বাস্থ্য ঝুঁকির হাত থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করা,শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক প্রয়োজনের ভিত্তিতে পেশাগত পরিবেশ সৃষ্টি এবং তা অব্যাহত রাখা হয়েছে কিনা সেদিকে বিশেষ ভাবে নজর দাড়ি করা হয়।তিনি বলেন, সর্বোপরি, পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা একজন শ্রমিকের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক কল্যাণ অন্তর্ভুক্ত করে ।পেশাগত নিরাপত্তা একজন শ্রমিক যখন নিজেকে শারীরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিকভাবে নিরাপদ রাখার জন্য যা করা দরকার তা আমরা যথারীতি করে থাকি।