ভারত বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং নিকটতম প্রতিবেশী। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছে বলে উভয় দেশ এবং বহির্বিশ্বেও জোরালো ধারণা চালু রয়েছে। তাই তিন বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার একান্ত বৈঠকে বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি সহায়তা, নিত্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, আরোপিত বাণিজ্যিক বাধা অপসারণ, আঞ্চলিক কানেকটিভিটি, বিবিআইএন কার্যকর, নেপাল ও ভুটানের জন্য বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের নিশ্চয়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি পরিবর্তিত বিশ্বে কূটনীতি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, জ্বালানি নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গাদের ফেরাতে বাংলাদেশকে ভারতের জোরালো সহায়তা নিয়েও কথা হয়েছে।
শেখ হাসিনা মূলত বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, বন্ধুত্ব থাকলে যে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব। আমরা বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে অনেক অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধান ইতোমধ্যে করেছি। আশা করি তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তিসহ অন্য বিষয়গুলোও শিগগির সম্পন্ন করতে পারব। উভয় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা এবং দুদেশ ও এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি একমত হয়েছি। আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে গতি সঞ্চার করার ক্ষেত্রে মোদিজির দূরদর্শী নেতৃত্বকে সাধুবাদ জানাই। বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নিকট প্রতিবেশী ভারত। প্রতিবেশীদের মধ্যে কূটনীতির ক্ষেত্রে দুদেশের সম্পর্ক রোল মডেল।
অপরদিকে নরেন্দ্র মোদি তার বক্তৃতায় বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়ে তারা জোর দিয়েছেন। এশিয়ার মধ্যে ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। এই অগ্রগতিকে আরও ত্বরান্বিত করতে দ্বিপক্ষীয় সমন্বিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তি (সেপা) করার আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে শুরু করতে চান তারা।
কুশিয়ারা চুক্তির আড়ালে হারিয়ে গেল তিস্তার পানিবণ্টন প্রসঙ্গ
কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনে প্রতিবেশী দুদেশ সমঝোতা স্মারক সই করলেও বরাবরের মতোই ঝুলে থাকল তিস্তা নদীর বিষয়ে একই রকমের চুক্তি। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিকে স্বাগত জানালেও বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ সংবাদ সম্মেলনে আনেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েছে ৫৪টি নদী এবং এগুলো শত শত বছর ধরে দুদেশের মানুষের জীবিকার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছে। কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষরে ভারতের দক্ষিণ আসাম ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে উপকৃত করবে। দুদেশের সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরে মোদি বলেন, আজ বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী এবং এই অঞ্চলে সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। গত কয়েক বছরে আমাদের সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বহু দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেছি।
দুই দেশের জাতীয় নির্বাচনের কারণে মোদি এবং হাসিনা- উভয়ের কাছে এই সফর গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলো বলছে, বাংলাদেশে আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের আগেই ভারত সফরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যা তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ভারতের অনলাইন দ্য হিন্দুতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইতিবাচক পদক্ষেপ সত্ত্বেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপ মোকাবিলা করছে বাংলাদেশ। এ অবস্থা নির্বাচনমুখী আওয়ামী লীগ সরকারের সামনে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। আগামী বছর নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনা শক্ত ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছেন। সব মিলিয়ে গণমাধ্যমগুলো এই সফরকে শুধু দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নয়; বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে।
পুরনো অনেক সমস্যার সুরাহা না হলেও দুদেশের সহযোগিতা নতুন নতুন ক্ষেত্রে বিস্তৃত করার কথা বলেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। এ ক্ষেত্রে বন্যা মোকাবিলায় সহযোগিতা, সন্ত্রাসবাদ, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি, তথ্যপ্রযুক্তি, মহাকাশ ও পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বিস্তৃত করার আলোচনার কথা জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরিতে সহযোগিতার আশ্বাসও দিয়েছেন তিনি।
তবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত সরকারের অনুদার নীতির কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। যখন দেশে পেঁয়াজের অভাব হয় তখন দেখা যায়, ভারত তার রপ্তানি নিষিদ্ধ করছে। চাল ও গমের ক্ষেত্রেও একই নীতির পুনরাবৃত্তি দেখা গেছে। প্রতিবেশীর প্রতি সহানুভূতির এই ঘাটতি কতটা প্রকট রূপ নেয়, তার আরেকটি দৃষ্টান্ত করোনা মহামারির সময়েও দেখা গেছে। আগাম টাকা দিয়েও বাংলাদেশ চুক্তিমতো টিকা পায়নি। বিপদের সময়ে বিকল্প উৎস সন্ধান করাটাই এখন বাংলাদেশের করণীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন দেনা পাওনার হিসেবে ধরলে আমরা কম পাচ্ছি। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আশ্বাস নির্ভরতাই বেশি। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ভারত নানা অজুহাতে তিস্তার পানি দিচ্ছে না। সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না। তারা বলছে সীমান্তে অপরাধ হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের সীমান্তেই অপরাধ হয়। ভারত যা চায় তা পায়, আমরা যা চাই তা পাই না।
এই সফরের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সব সময়ই কথা হয়, আলাপ আলোচনা হয়। এটা তো রুটিন কাজ। কিন্তু অর্জন কী হয় সেটাই প্রশ্ন। গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের কোনো সমস্যার সমাধান হয়নি।
অপরদিকে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির মনে করেন, নির্বাচনের আগে যেহেতু এই সফর তাই স্বাভাবিক কারণেই দুই দেশের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা তো হবেই। তার মতে কী আলোচনা হবে সেটা তো আর আমরা জানতে পারব না। কারণ রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা তো আর প্রকাশ করা হয় না। তিনি মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে সুসম্পর্ক আছে। কিন্তু সেই সম্পর্ক হতে হবে সমতার ভিত্তিতে। দেনা পাওনার হিসেবে ধরলে আমরা কম পাচ্ছি। ভারতকে আমরা যে রকম সুযোগ সুবিধা দিই। আমরাও তো সে রকম সুযোগ সুবিধা চাই। আর এটা সুষম হতে হবে। তিনি আরও বলেন, তিস্তার পানি দিচ্ছে না। কিন্তু আরও ছয়-সাতটি নদীর পানি নিয়েও তো কোনো আগ্রহ দেখি না। আসলে আমাদের থাকলেও তাদের আগ্রহ খুবই কম। তার মতে, আমরা যতই ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্কের কথা বলি না কেন দেশের সাধারণ মানুষ কিন্তু সুষম সম্পর্ক চায়। সেটাই আসলে দরকার।
তবে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি এভাবে না দেখে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুষম সম্পর্ক গড়ে উঠুক সেটা কাম্য। বিভিন্ন চুক্তিতে দুই পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণ করে যাতে সুষম হয় এবং পরস্পরের জন্য সুফল বয়ে আনে, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। আমরা ভারতকে বেশি দিচ্ছি আর পাচ্ছি কম, এমন একটা ধারণা প্রচলিত আছে। কাজেই এই চুক্তি যদি একপক্ষীয় হয়, তবে এটি টেকসই হবে না।
উল্লেখ্য, ৪ দিনের সফর শেষে আজ (৮ সেপ্টেম্বর) দেশে ফিরছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
যেসব বিষয়ে সমঝোতা স্মারক হলো
মঙ্গলবার দিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে ভারত-বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে দুই দেশের কর্মকর্তারা ৭টি সমঝোতা স্মারকে সই করেন।
১. সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের অধীনে কুশিয়ার নদী থেকে বাংলাদেশের ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ)।
২. বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা বিষয়ে ভারতের বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সিএসআইআর) সঙ্গে বাংলাদেশের সিএসআইআরের মধ্যে সমঝোতা স্মারক।
৩. বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে ভারতের ভোপালে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমির মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক।
৪. ভারতের রেলওয়ের প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোতে বাংলাদেশ রেল