শনিবার, ০৪ মে ২০২৪, ১০:৪৮ পূর্বাহ্ন

বেহাল মর্গ ব্যবস্থা

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • সর্বশেষ আপডেট : মঙ্গলবার, ৪ অক্টোবর, ২০২২
  • ৮০ বার পড়া হয়েছে / ইপেপার / প্রিন্ট ইপেপার / প্রিন্ট

সদর হাসপাতাল থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে মৎস্য অফিসের পাশে আবাসিক এলাকায় লালমনিরহাটের একমাত্র মর্গটি। প্রায় চার দশক আগে নির্মিত যেন পোকামাকড়ের ঘরবসতি। নেই বিদ্যুৎ সংযোগ ও আধুনিক যন্ত্রপাতি। বদ্ধঘরে মোম জ্বালিয়ে চলে ময়নাতদন্তের কাজ।মরদেহ ধোয়া পানি ফেলা হয় পুকুরে, যেখানে পুরোদমে চলছে মাছ চাষ। তাছাড়া প্রধান সড়ক থেকে মর্গে মরদেহ নেওয়ার জন্য কোনো রাস্তাও নেই। একই অবস্থা নোয়াখালীতেও, জেলায় একটি সরকারি মেডিক্যাল কলেজ থাকলেও নেই নিজস্ব হাসপাতাল কিংবা মর্গ। আড়াইশ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের মর্গেই চলে কলেজ শিক্ষার্থীদের ব্যবহারিক পাঠ। সেখানেও আবার আধুনিক সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই চলছে মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের কাজ। তাই মানা যাচ্ছে না বৈজ্ঞানিক নির্দেশিকা। আবার ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ছাড়া ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণও থেকে যাচ্ছে অজানা। রিপোর্ট দেওয়া হচ্ছে গতানুগতিক। কেবল লালমনিরহাট ও নোয়খালীই নয়, এ যেন পুরো দেশেরই মর্গ ব্যবস্থার চিত্র। আবার যেসব সরকারি মেডিক্যাল কলেজে মর্গ রয়েছে, সেগুলোতেও পরিপূর্ণ বৈজ্ঞানিকভাবে ময়নাতদন্ত হয় না আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে। তাই পর্যাপ্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে না। একই সঙ্গে ডোমদের জন্যও নেই কোনো প্রশিক্ষণ, দেশে এ কাজটি চলছে বংশ পরম্পরায়। সেই পুরনো ধাঁচেই ছুরি-কাঁচি দিয়েই কাটা হয় অপঘাতে মৃতদের দেহ। মৃত্যুর কারণ জানতে কোনো আধুনিক যন্ত্র ছাড়াই হয় ময়নাতদন্ত। এমনকি জেলা মর্গগুলোতে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য থাকে না ফ্রিজিং ব্যবস্থা। নমুনা সংরক্ষণেরও কোনো আধুনিক সুবিধা নেই। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা জানান, অল্প সময়ের জন্য মৃতদেহ সংরক্ষণের প্রয়োজন হলে তা ২ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখতে হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনের জন্য হলে দেহকে সংরক্ষণ করতে হয় মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়। তবে দেশের বেশিরভাগ মর্গেই মৃতদেহ সংরক্ষণের এমন ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে আবার বিকাল ৫টার পর দেশের কোথাও ময়নাতদন্ত করার বিধান নেই। মূলত দিনের আলোতেই কাজটি করতে এমন বিধান করা হয়েছে। ফলে বিকালের পর মর্গে আসা মৃতদেহকে সংরক্ষণের জন্য ফ্রিজার জরুরি হলেও দেশের অনেক জেলাতেই সে ব্যবস্থা নেই। ময়নাতদন্তের জন্য মাইক্রবায়োলজি ও প্যাথলোজির ল্যাবরেটরি প্রয়োজন হয়। আর রাসায়নিক বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন পড়ে কখনো কখনো। তখন সিআইডি পুলিশের ফরেনসিক ল্যাবে নমুনা পাঠানো হয়, যেটি দেশের একমাত্রা রাসায়নিক বিশ্লেষণের ল্যাবরেটরি।

মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের তথ্য বলছে, যেসব স্থানে সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মর্গ রয়েছে, সেসব জেলা হাসপাতালে মর্গ নেই। শিক্ষার্থীদের হাতে কলমে চিকিৎসাবিদ্যা শেখানোর জন্য সেগুলো মূলত কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের অধীনে থাকে। যদিও দেশে ৩৭টি সরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে মর্গ রয়েছে মাত্র ১৮টিতে।যুক্তরাজ্যের দ্য রয়েল কলেজ অব প্যাথোলজিস্টস বলছে, কয়েক ধরনের ময়নাতদন্ত রয়েছে। তবে মূল ময়নাতদন্ত দুই প্রকার- ফরেনসিক ও ক্লিনিক্যাল। এর মধ্যে ফরেনসিক ময়নাতদন্ত মূলত সন্দেহজনক, হিংসাত্মক বা মৃত্যুর অজানা কারণের ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। আর কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই চিকিৎসাধীন অবস্থায় বা আরও ভালোভাবে কারণ বোঝার জন্য মৃতের নিকটাত্মীয়দের সম্মতির ভিত্তিতে করা হয় ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত। গবেষণার জন্য ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে দেশে শুধু ফরেনসিক ময়নাতদন্তই করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ডা. কামদা প্রসাদ সাহা বলেন, মর্গের ভবন আধুনিক না হওয়ার কারণেই দেশে ময়নাতদন্তের এ দুরবস্থা। ফরেনসিক মেডিসিনে সুযোগ-সুবিধা না থাকলে চিকিৎসকরাও এখন আর এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হতে আগ্রহী হচ্ছেন না। শুধু সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি অবহেলিত থাকছে। তাই ফরেনসিক মেডিসিন চিকিৎসকদের এ বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। এছাড়া মৃতদেহ কাটাকাটির জন্য অন্তত ২৪ ধরনের যন্ত্র প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে জটিল ময়নাতদন্তের ক্ষেত্রে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন এক্স-রে ও এমআরআই মেশিনের সাহায্য লাগে। অথচ দেশে কেবল পাঁচ থেকে সাত ধরনের যন্ত্র দিয়ে ময়নাতদন্ত করা হয়। আবার যন্ত্র দিলেও তা ব্যবহারে পারদর্শী লোকবলের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ সোয়েব নাহিয়ান। তিনি বলেন, আধুনিক যন্ত্র চালানোর লোকবল দেশে নেই। যেসব ডোম মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করেন তাদেরও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেই। তারা মূলত দেখতে দেখতে এসব শিখেছেন।তিনি আরও বলেন, ময়নাতদন্তে আমরা অন্যান্য দেশের মতো আধুনিক হতে পারিনি। তবে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের বাইরেও যেসব ডোম ময়নাতদন্তে সহায়তা করেন তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিতে পারলে কাজ আরও সুন্দর হতো।ময়নাতদন্তে চিকিৎসকের সহায়তাকারী ডোম বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বংশ পরম্পরায় এ পেশায় আসছেন। এদের কারোরই নেই আধুনিক প্রশিক্ষণ। বান্দরবান জেলার ডোম মো. ওসমান প্রায় ৪০ বছর ধরে এ পেশায়। আগামী দেড় থেকে দুই বছরের মধ্যে অবসরে যাবেন তিনি। পরবর্তীতে এ পেশায় উপযুক্ত করে তুলতে তার নাতিকে সঙ্গে রেখে কাজ শিখিয়েছেন। স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ফরেনসিক মেডিসিনে ১৯ জন অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছেন তিন জন, আট সহযোগী অধ্যাপক রয়েছেন ১৯ জনের বিপরীতে ও ২৭ জন সহকারী অধ্যাপকের বিপরীতে রয়েছেন কেবল ১১ জন। এ বিভাগে যারা প্রভাষক রয়েছেন তাদেরকেও বিভিন্ন বিভাগ থেকে প্রেষণে নিয়ে আসা। ফলে তাদেরকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ধরা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞরা। সরকারি মেডিক্যাল কলেজে বেসিক সায়েন্সের এ বিভাগে ১৬৯টি পদের মধ্যে ৮৮টিই খালি রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ময়নাতদন্তের পরবর্তী সময়ে আদালতে সাক্ষী দেওয়ার জন্য হাজিরা ও প্রতিবেদন তৈরিতে চাপ থাকে। আবার আইনি কারণে অনেক অবসরপ্রাপ্ত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদেরও নিয়মিতভাবে কর্মস্থল ও আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তাই ফরেনসিক মেডিসিনে চিকিৎসকদের আগ্রহ কম। আর সে কারণে জেলা হাসপাতালগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ না থাকায় মেডিক্যাল অফিসারদের ময়নাতদন্ত করতে হয়। এতে ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ সঠিক না হওয়ার শঙ্কাও থেকে যায়। নির্ভুল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় ছাড় পেয়ে যায় অনেক অপরাধী। একই সঙ্গে ক্লিনিক্যাল ময়নাতদন্ত না হওয়ায় পিছিয়ে থাকছে গবেষণার বিষয়ও। মেডিকো লিগ্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি অধ্যাপক ডা. সেলিম রেজা এ বিষয়ে বলেন, ময়নাতদন্তের জন্য ফরেনসিক মেডিসিন বিশেষজ্ঞদের আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হয় না। একই সঙ্গে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও উপেক্ষিত। আর ময়নতদন্তের প্রতিবেদন নিয়ে ঝুঁকির বিষয়টি তো রয়েছেই। নিয়মিতভাবে আদালতে হাজির হয়ে সাক্ষী দেওয়াসহ নানা কারণে ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগে চিকিৎকরা আসতে চান না।

আক্ষেপ নিয়ে এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের লক্ষ্যে দেশে-বিদেশে ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। সেখানে ফরেনিসকের গবেষণায় বাংলাদেশ পিছিয়ে রয়েছে।

আরো পড়ুন

এস এন্ড এফ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

Developer Design Host BD