শহরাঞ্চলে কিশোর গ্যাং কালচার দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। ভয়ংকর কিশোর গ্যাং এখন পেশাদার সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছে। চাঁদাবাজি, ভূমি দখলদারিত্ব, হুমকি, মারামারি, ভাড়াটিয়া খুনি ও পথেঘাটে মেয়েদের উত্ত্যক্তসহ বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ড করে যাচ্ছে তারা। এমনকি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কিংবা অন্য গ্যাংয়ের সঙ্গে তুচ্ছ বিরোধকে কেন্দ্র করে খুন-খারাবি থেকেও পিছপা হচ্ছে না তারা।
আগে গোপনীয়তা রাখলেও এখন প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিচ্ছে তারা। এসবের ছবি ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করে একেক পক্ষ তাদের সামর্থ্য-ক্ষমতা প্রদর্শন করছে।
২০২১ সালের জুলাই মাসে সাভারের আশুলিয়ার ভাদাইল এলাকায় প্রতিবেশী ভাতিজি ও তার বান্ধবীসহ উত্তর পবনারটেক এলাকায় ঘুরতে যায় চার পোশাক শ্রমিক। এ সময় কিশোর গ্যাংয়ের ১০ থেকে ১২ জন সদস্য তাদের নিজর্ন স্থানে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়। কিশোরী ও প্রতিবেশী চাচাদের পৃথক স্থানে বেঁধে মারধর করে। এক পর্যায়ে এক কিশোরীকে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ করে। ঘটনার এক মাস পর ভিডিওর স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে গ্যাংয়ের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এরপর আসি নীলা হত্যায়
রাতে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে নীলা রায় ও তার ভাই অলক রায়ের পথরোধ করে বখাটে মিজানুর রহমান। পরে তার ভাইয়ের কাছ থেকে নীলাকে ছিনিয়ে নিয়ে একটি নির্জন স্থানে নিয়ে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যান কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাতে তাকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
এ ঘটনায় নীলার বাবা নারায়ণ রায় মিজানুর রহমান, তার বাবা আব্দুর রহমান ও মা নাজমুন নাহার সিদ্দিকাসহ অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে সাভার থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। এ ঘটনায় মিজানুরসহ তার বাবা মাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
এরপর আলোচনায় আসে রোহান হত্যা
প্রেমঘটিত বিরোধের জেরে ২০২১ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রোহান (১৭) নামে এক শিক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
নিহতের স্বজন আকাশের দেওয়া তথ্য মতে, রোহান একটি মেয়েকে ভালবাসত। তাকে উত্ত্যক্ত করত কয়েকজন বন্ধু। এর মধ্যে ব্যাংক কলোনির হৃদয় এবং শুভ নামে দুইজন রোহানকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। পরে রোহান তার চাচাতো ভাই আকাশসহ চার বন্ধু সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় যায়। মোটরসাইকেল থেকে নামতেই হৃদয় ও শুভ হামলা চালায়।
হৃদয় ও শুভসহ প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন আগে থেকেই পরিকল্পনা করে ওঁৎ পেতে ছিল। হাতাহাতির এক পর্যায়ে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় তারা। পরে ভোরে ধামরাইয়ের এক আত্মীয়র বাড়ি থেকে কিশোর গ্যাং লিডার হৃদয়কে আটক করে পুলিশ। আটক হৃদয় (১৭) সাভার সদর ইউনিয়নের মল্লিকার টেক এলাকার ঝন্টু মিয়ার ছেলে।
ড্যাফোডিলের ছাত্র অন্তর হত্যা
গতবছরের ২৭ অক্টোবর সন্ধ্যা সাতটার দিকে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির অদূরে খাগান বাজারের লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে ৮-১০ যুবক হাসিবুল হাসানকে ধরে নিয়ে যান কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। রাত আটটার দিকে অপহরণকারীরা একটি রিকশায় করে অজ্ঞান অবস্থায় হাসিবুলকে খাগান বাজারে পাঠিয়ে দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী হাসিবুলকে দেখতে পেয়ে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান। কর্তব্যরত চিকিৎসক হাসিবুলের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক জখম দেখতে পান। আঘাত গুরুতর হওয়ায় তিনি হাসিবুলকে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় তাঁর পরিবারের সদস্যরা হাসিবুলকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।
শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি কিশোর গ্যাং লিডার রাহাত সরকারকে গাজীপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিলো।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেড়ে ওঠে কিশোর সন্ত্রাসীরা। এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত করে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। কেবল সাভার নয়, সারা দেশেই কিশোর সন্ত্রাসীদের অপরাধমূলক তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিষয়টি শুধু অভিভাবক শ্রেণি নয়, রাষ্ট্রের জন্যও দুর্ভাবনার। যারা কিশোর বয়সে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, তারা যে একদিন শীর্ষ সন্ত্রাসীর খাতায় নাম লেখাবে না, তার নিশ্চয়তা কী?
সমাজদেহে ব্যাপকভাবে এ ক্ষত বিস্তারের আগেই প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক সংগঠনসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের এ ব্যাধি রোধকল্পে এগিয়ে আসা উচিত। এ ক্ষেত্রে পরিবারের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে মনে করি আমরা। শিশুরা অসৎ সঙ্গ বর্জনসহ যে কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ থেকে দূরে থাকার শিক্ষা যদি জীবনের শুরুতেই পায়, তাহলে অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে বলে আশা করা যায়।
আজকাল মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ও আকাশ সংস্কৃতির থাবায় অনেক কিশোর-কিশোরীই বিপথগামী হচ্ছে। এদের মধ্যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক কারবারে যুক্তরা কী ভয়াবহ পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সাভারের অনেক ঘটনা রয়েছে যা এর বড় প্রমাণ। কিশোর গ্যাং তথা কিশোর অপরাধ বর্তমানে একটি সামাজিক সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আজকাল এই অপরাধীদের হাতে দেশের স্কুল-কলেজগামী কিশোরীরা শুধু লাঞ্ছিত, অপমানিত ও যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে না, একইসঙ্গে তাদের মাধ্যমে বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের বিস্তার ঘটছে, যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত। ক্ষেত্রবিশেষে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত ও নিপীড়নের মাত্রা এতটাই প্রকট হয় যে, ভুক্তভোগী অনেকে আত্মহননের পথেও পা বাড়ায়।
দেখা গেছে, গ্যাং সদস্যদের অধিকাংশই দরিদ্র ও স্কুল থেকে ঝরেপড়া ছাত্র। এসব কিশোর পরিবারসহ বিভিন্ন কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে প্রথমে মাদকের নেশায় জড়ায়। পরে এরা সমবয়সি অন্যান্য কিশোরের সঙ্গে মিলে অন্য একটি জগৎ তৈরি করে। এরপর কয়েকজন মিলে তৈরি করে একটি গ্যাং। কিশোর বয়সের এসব অপরাধীর মধ্যে এক ধরনের হিরোইজমও কাজ করে থাকে। কার্যকরণ যা-ই হোক, পরিবার ও সমাজের ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ছাড়া গ্যাং কালচার রোধ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে প্রথমেই এগিয়ে আসতে হবে পিতামাতা তথা অভিভাবকদের। অভিভাবকদের তীক্ষ দৃষ্টিই তাদের সন্তানদের বিপথগামিতা থেকে রক্ষা করতে পারে। সন্তান কী করে, কার সঙ্গে মেশে, কোথায় সময় কাটায়— এসব বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলে তাতে সুফল পাওয়া যাবে বলে মনে করি।
আশার কথা, কিশোর বয়সিদের মধ্যে সংবেদনশীল আচরণ, সহমর্মিতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করার লক্ষ্যে সরকার দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে কিশোর-কিশোরী ক্লাব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যে দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় এ ধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ১১ থেকে ১৯ বছর বয়সি ছেলেমেয়েরা নিজ নিজ এলাকায় স্থাপিত এসব ক্লাবের সদস্য ও পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে।
সমাজে বিদ্যমান নানা অসঙ্গতির ওপর বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চার পাশাপাশি ক্লাবের সদস্যরা হরেকরকম খেলাধুলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ারও সুযোগ পাবে। প্রতিটি ক্লাবেই বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ক্রীড়া-সরঞ্জাম সরবরাহ করা ছাড়াও বই ও পত্র-পত্রিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা হবে।
সব মিলে উদ্যোগটি যে প্রশংসনীয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সারা দেশে এ ধরনের ক্লাব প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি কিশোর অপরাধ তথা কিশোর গ্যাংয়ের জন্ম ও বিকাশ রোধে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ পরিবার ও সমাজের আন্তরিক ভূমিকা কাম্য।