লোকচক্ষুর অন্তরালে থাকা একদল গারো নারী মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধ ও জীবনের গল্প নিয়ে শরিফুল ইসলাম পলাশের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘আবছায়া’। ‘আচিক’ বা গারো ভাষায় নির্মিত চলচ্চিত্রটির দৃশ্যায়নের কাজ চলছে। আগামী বিজয় দিবসে ৪০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি দেশে ও দেশের বাইরে মুক্তি দেওয়া হবে।১৯৭১ সালে ১১ নম্বর সেক্টরের ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নিরঞ্জন সিংহ চৌহানের নেতৃত্বে গড়ে তোলা কমলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন একদল গারো নারী। সকলেই নেত্রকোণার সীমান্তঘেঁষা কলমাকান্দা উপজেলার লেঙ্গুরায় বসবাস করতেন। বালুচরা সেক্রেড হার্ট স্কুলের তৎকালীন প্রধান শিক্ষক গ্যাব্রিয়েল রাংসার কথায় অনুপ্রাাণিত হয়ে তারা রণাঙ্গনের পথে পা বাড়ান।যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও গোপনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আনাগোনার তথ্য সরবরাহ থেকে অস্ত্র পরিচালনা সব কাজই করেছেন সমাজ ও পরিবারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এ দলটির নেতৃত্ব ছিলেন মল্লিকা ঘাগ্রা। অন্যদের মধ্যে তুষি হাগিদক, মগ্ধলিনা নেংমিঞ্জ, সঞ্চিতা জরিনা রেমা, পরিচয় চিসিম, সেলিনা হাউই, রিতা নকরেক, জিতা নকরেক, টুরটুরি নকরেক, ছায়া বনোয়ারি, সুজানা জাম্বিল, মুকুল আজিম, রচিতা হাগিদক, বেঞ্জিনা নকরেক এবং হাসিনা বনোয়ারিসহ আরো ১৫ জন।১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর তার প্রভাব পড়ে আদিবাসী পল্লীতেও। দেশজুড়ে অচলাবস্থায় ভয়-আতঙ্কে মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় গোপন করে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান এই বীর নারীরা।স্বাধীনতার পর কেটেছে ৫১ বছর। এখেনো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি সেই নারীরা। স্বীকৃতির জন্য ঘুরছেন দায়িত্বশীলদের দ্বারে দ্বারে। সেই বীর নারীদের একজন তুষি হাগিদক। অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষিকা। তার জবানিতে উঠে এসেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জানা-অজানা গল্প। এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটি মুক্তিযুদ্ধের অজানা একটি দিক উম্মোচন করবে বলে আশা করছেন নির্মাতা।প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির পরিচালক শরিফুল ইসলাম পলাশ বলেন, প্রায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে আমরা কাজটা করছি। স্বাধীনতার এত বছর পর তা করা মোটেও সহজসাধ্য ছিলো না। সহযোগী সকলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কাজটি আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে।নির্মাতা আরো বলেন, একদিকে অজানা বীরত্ব-বঞ্চনার গল্প, অন্যদিকে গারো বা আচিক ভাষায় নির্মাণের কারণে চলচ্চিত্রটি নিয়ে আমরা আশাবাদী। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বিজয় দিবসে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবে। এর মধ্যদিয়ে এসকল বীর নারীদের স্বীকৃতির পথটি সুগম হবে।প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য লিখেছেন গারো ভাষার জনপ্রিয় কবি মতেন্দ্র মানখিন। চলচ্চিত্রটির দৃশ্যধারণের কাজ চলছে ময়মনসিংহের ধোবাউড়া ও নেত্রকোণার কলমাকান্দার সীমান্তবর্তী এলাকায়। ‘দ্য পাথ ক্রিয়েটর’ এ প্রামাণ্য চলচ্চিত্রটির নির্মাণ কাজ করছে। আর পৃষ্ঠপোষকতা করছে আদিবাসী বিষয়ে কর্মরত বেসরকারি সংস্থা এশিয়ান ইন্ডিজেনাস পিপলস প্যাক্ট (এআইপিপি)।প্রসঙ্গত, ‘আবছায়া’ শরিফুল ইসলাম পলাশের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণাধর্মী তৃতীয় প্রামাণ্য চলচ্চিত্র। এর আগে, ২০২১ সালে প্রথমবারের মতো গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা মাস্টার রনি হিজড়ার অজানা গল্পে ‘অগ্নিঝরা দিনের না বলা কথা’ ও চলতি বছরে প্রচারিত রাজবাড়ীর তিন সহোদর মুক্তিযোদ্ধা গীতা, ইরা ও ভক্তি করের গল্পে ‘রণাঙ্গনের তিনকন্যা’র শিরোনামের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র বেশ প্রশংসিত হয়েছে।