বুধবার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩০ পূর্বাহ্ন

ইউজিসির আল্টিমেটামে প্রাইভেট ভার্সিটি

নিজস্ব প্রতিবেদক
  • সর্বশেষ আপডেট : মঙ্গলবার, ১৫ নভেম্বর, ২০২২
  • ১২৩ বার পড়া হয়েছে /

আবারও নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এবার নজর দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর। আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন থেকে শুরু করে অলিগলি, কোনা-কাঞ্চিতে গড়ে ওঠা প্রাইভেট ভার্সিটিগুলোর বিরুদ্ধে অনেকটা চিরুনি অভিযানে নেমেছে সরকারি এই প্রতিষ্ঠান। তবে ইউজিসির এই নড়াচড়ায় বেরিয়ে এসেছে চমকপ্রদ সব তথ্য।দেখা যাচ্ছে যে, অনেক প্রাইভেট ভার্সিটিতে নেই বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট আইনের বাস্তবায়ন, মালিক বা উদ্যোক্তা বলি- তাদের পরিচালনা পর্ষদে রয়েছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব। অনেক ভার্সিটিতে নেই উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কিংবা ট্রেজারার। নেই স্থায়ী ক্যাম্পাস। তা ছাড়া অতিরিক্ত টিউশন ফি আদায়সহ নানা সমস্যা তো রয়েছেই। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে এবার কড়া হুশিয়ারি দিয়েছে সরকার, ইউজিসি এসবের বিরুদ্ধে নেমেছে শুদ্ধি অভিযানে। এতে আইন মানতে বাধ্য করা হচ্ছে। আর এসব কর্মকাণ্ডে সম্প্রতি ভার্সিটি মালিকদের মধ্যে বেড়েছে উদ্বেগ ও অস্বস্তি। শাস্তি এড়াতে কেউ কেউ রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে এরই মধ্যে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে এ দপ্তর থেকে ও দপ্তরে; শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি)।ইউজিসির সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে না গেলে ২২ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। আইন অনুযায়ী নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি- দেশের এমন ২২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এবার ইউজিসি।প্রতিষ্ঠানটির সিদ্ধান্ত- আসছে ডিসেম্বরের মধ্যে যদি এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব ক্যাম্পাসে না যায়, তা হলে আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে স্থায়ী ক্যাম্পাস ছাড়া অন্যান্য ক্যাম্পাস বা ভবনগুলো অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।উল্লেখ্য, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে বলা আছে- প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে নিজস্ব স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে হবে। এ জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরে এক একর ও অন্য এলাকায় দুই একর জমি থাকতে হবে। ২০১০ সালে সংশোধিত আইন হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যাওয়ার সময় বেঁধে দিয়েছিল সরকার।কয়েক দফা সময় দেওয়ার পরও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি। তবে এসবের তোয়াক্কায় করেনি অনেক প্রাইভেট ভার্সিটি। কোনো কোনো ভার্সিটি প্রতিষ্ঠার বয়স দেড় যুগের বেশি, কোনোটির বয়স দুই দশকের বেশি হয়ে গেলেও নিজস্ব ক্যাম্পাসে তারা যায়নি। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, ৫১টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২৩টি এখনো পুরোপুরিভাবে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি।বিষয়টি নিয়ে ইউজিসির দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, প্রাইভেট ভার্সিটির মধ্যে যারা বিশ্ববিদ্যালয় আইন মোতাবেক নির্দিষ্ট সময়ের পার হয়ে গেলেও নিজস্ব ক্যাম্পাসে যায়নি, তাদের আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে হবে। তা না হলে জানুয়ারি থেকে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করে দেওয়া হবে।এর বাইরে সরকার যেসব ভার্সিটিতে শুদ্ধি অভিযান চালিয়েছে, এর মধ্যে অন্যতম মানারাত ভার্সিটি। যার দরুন গত ৮ সেপ্টেম্বর মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি বোর্ডের সবাইকে সরিয়ে ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠন করে দিয়েছে সরকার। পুনর্গঠিত ১৩ সদস্যের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলামকে।এর আগে গত ১৬ আগস্ট নর্থ সাউথ ভার্সিটির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ভেঙে দিয়ে ১২ সদস্যের নতুন বোর্ড গঠন করে দিয়েছে সরকার। পুরনো ট্রাস্টি বোর্ডের সাতজনই নতুন বোর্ড থেকে বাদ পড়েছেন। এদের মধ্যে চারজন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলায় কারাগারে। দুর্নীতি, রাষ্ট্রবিরোধী ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ তুলে ১৬ ট্রাস্টি বোর্ড ভেঙে দেয় সরকার।শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের (বিওবি) কিছু সদস্য এবং কর্মকর্তা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকতা, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতায় জড়িত বলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে প্রমাণ হয়েছে।নর্থ সাউর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আতিকুল ইসলাম বলেন, সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইনের মধ্যে রেখে শৃঙ্খলার সঙ্গে পরিচালনা করতে চাচ্ছে- এটি ভালো উদ্যোগ। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় কর্তৃপক্ষের অনেক সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। এসব বিবেচনায় সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোক্তরা উভয় মিলেই সমাধানের পথে এগোতে পারে।আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আইনি ভিত্তি নেই উল্লেখ করে সেখানে ভর্তি না হতে পরামর্শ দিয়েছে ইউজিসি। গত ৮ সেপ্টেম্বর ইউজিসি এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য প্রকাশ করে। ইউজিসি বলছে, এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইউজিসি এ সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে।তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের জন্য দেশের উচ্চশিক্ষা সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি হচ্ছে বলেও মত দিয়েছে ইউজিসি। ইউজিসি সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনানুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়টি সাময়িক অনুমতিপত্রের মেয়াদের মধ্যে সনদপত্রের জন্য আবেদন করেনি এবং সনদপত্র পাওয়ার জন্য শর্তগুলো পূরণেও ব্যর্থ হয়েছে।এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির কার্যক্রমের আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এ জন্য জনস্বার্থে শিক্ষার্থীদের এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।’ এদিকে রাজধানীর বাইরেও একই চিত্র পেয়েছে ইউজিসি। গত ১৭ মে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ করা হয়েছে কক্সবাজার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে- এর বর্তমান ক্যাম্পাস ‘মোটেও শিক্ষার্থীবান্ধব নয়’।ইউজিসির তথ্য ঘেটে দেখা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নেই; উপ-উপাচার্য নেই ৭২ প্রতিষ্ঠানে আর কোষাধ্যক্ষ নেই ৪৩টিতে। বর্তমানে দেশে অনুমোদিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ১০৫টি। বিষয়গুলো নিয়ে কথা হলো ইউজিসি পরিচালক (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়) মো. ওমর ফারুখের সঙ্গে।তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, সরকার নির্দেশ দিয়েছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আইন মেনে মানসম্পন্ন পাঠদান পরিচালনা করবে। এক্ষেত্রে যারা আইন মানবে না, তারা তো ক্ষতিগ্রস্ত হবেই। মানসম্পন্ন পাঠদানের জন্য, সরকারনিযুক্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, ট্রেজারার থাকতে হবে, উপযুক্ত ক্যাম্পাস প্রয়োজন, শিক্ষক প্রয়োজন, লাইব্রেরি-ল্যাব প্রয়োজন। যারা এখনো সাময়িক সনদ নিয়ে পরিচালনা করছেন, স্থায়ী সনদের যোগ্যতা অর্জন করেনি, তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে।একনজরে বেশ কিছু প্রাইভেট ভার্সিটির হালহকিকত দেখা যাক- ঢাকার পিপল’স ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালে সাময়িক অনুমতি পায়, তবে এখনো নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। তাদের বিষয়ে ইউজিসির বক্তব্য, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে তাদের সম্পূর্ণ শিক্ষা কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর করতে হবে। অন্যথায় অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।২০০০ সালে সাময়িক অনুমোদন পাওয়া ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বর্তমানে বনানী ও গ্রিন রোডে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ ইউজিসিকে জানিয়েছে, তারা ২০১৭ সাল থেকে আশুলিয়ায় ৩ দশমিক ৩০ একর নিজস্ব জমিতে স্থায়ী ক্যাম্পাস চালু করেছে।ঢাকার মোহাম্মদপুরের আদাবরে নির্মাণাধীন ভবনে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। তাদেরও ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে হবে। ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ গাজীপুরে জমি কিনেছে। তবে তাদের জমিটি ভাওয়াল জাতীয় উদ্যানের কাছে হওয়ায় বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পায়নি। ইউজিসির ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়টির নামের পাশে লাল তারকা চিহ্ন দেওয়া হয়েছে।সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির তেজগাঁও শিল্প এলাকায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে আংশিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। নিজস্ব ক্যাম্পাসের বিষয়ে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলেছে, আগামী বছরের অক্টোবরে তাদের কাজ শেষ হবে। তবে ইউজিসি বলেছে, এ বছরের মধ্যেই তাদের নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে হবে।২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির দাবি, ২০২৪ সালের মধ্যে ডেমরায় গ্রিন মডেল টাউনে স্থায়ী ক্যাম্পাসে তারা যেতে পারবে; কিন্তু ইউজিসি সেটি মানেনি। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত স্টেট ইউনিভার্সিটি চায় ২০২৫ সালের মধ্যে ক্যাম্পাসে যেতে; ইউজিসি তাতে নারাজ। আশা ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ ২০০৬ সালে সাময়িক অনুমোদন পেলেও স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার বিষয়ে তাদের যথেষ্ট সদিচ্ছার অভাব প্রতীয়মান হয়েছে বলে জানিয়েছে ইউজিসি।প্রাইভেট ভার্সিটি তালিকার শীর্ষে থাকা প্রতিষ্ঠানও বাদ পড়েনি অভিযান থেকে। এর মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় বলেছে, তাদের প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। প্রায় ৫৫ শতাংশ শেষ এবং ডিসেম্বরের মধ্যে কাজ শতভাগ শেষ হবে। ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকেই নিজস্ব ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু করা হবে। ডিসেম্বরের মধ্যে নিজস্ব ক্যাম্পাসে যেতে সময় বেঁধে দেওয়া বাকি ভার্সিটিগুলো হলো- শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি, মিলেনিয়াম ইউনিভার্সিটি, প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়া, উত্তরা ইউনিভার্সিটি, ভিক্টোরিয়া ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ, প্রাইমএশিয়া ইউনিভার্সিটি।

আরো পড়ুন

এস এন্ড এফ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড © সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত

Developer Design Host BD