বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) পাশ কাটিয়ে নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে দ্রব্যমূল্যের চাপে থাকা নিম্ন আয়ের লোকজনের দুর্ভোগ আরও বেড়ে যাবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।গত ১২ জানুয়ারি নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়ে গেজেট প্রকাশ করা হয়। নতুন দর (বিলিং মাস) জানুয়ারি থেকেই কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুতের গ্রাহক ও ধরন ভেদে যেমন দামের তারতম্য রয়েছে, তেমনি ভোল্টেজ ভেদেও রয়েছে দরের পার্থক্য। আবার পিক (সন্ধ্যা ৬ থেকে রাত ৯টা) অফ পিকে বিদ্যুৎ ব্যবহারে রয়েছে ভিন্ন দর।আবাসিকের লাইফলাইন গ্রাহকের (৫০ ইউনিট ব্যবহারকারী) ইউনিটপ্রতি ১৯ পয়সা বাড়িয়ে ৩.৯৪ টাকা, প্রথমধাপে ৭৫ ইউনিট ব্যবহারকারীর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৪০ টাকা করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ৭৬-২০০ ইউনিট পর্যন্ত ২৯ পয়সা হারে বাড়িয়ে ৬.০১ পয়সা, ২০১-৩০০ ইউনিট পর্যন্ত ৩০ পয়সা বাড়িয়ে ৬.৩০ টাকা, ৩০১-৪০০ ইউনিট ব্যবহারির বিল ৩২ পয়সা বাড়িয়ে ৬.৬৬ টাকা, ৪০১-৬০০ ইউনিট পর্যন্ত ৫০ পয়সা বাড়িয়ে ১০.৪৪ টাকা এবং সর্বশেষ ধাপ ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ব্যবহারকারীদের ১১.৪৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১২.০৩ টাকা করা হয়েছে। উল্লেখিত দর নিম্নচাপ শ্রেণির গ্রাহকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। মধ্যম ও উচ্চচাপের গ্রাহকদের জন্য পৃথক দর নির্ধারণ করা হয়েছে। মধ্যম চাপে ৫০ কিলোওয়াট থেকে ৫ মেগাওয়াট পর্যন্ত গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেট ৮.৮২ টাকা, অফ-পিকে ৭.৯৪ এবং পিকে ১১.০৩ টাকা ধরা হয়েছে।কৃষি সেচের দর ২১ পয়সা বাড়িয়ে ৪.৩৭ টাকা। এই ধরনের গ্রাহকের মধ্যম চাপে (১১ কেভি) ফ্ল্যাট রেটে ৫.২৫ টাকা, অফ-পিকে ৪.৭৩ টাকা, পিকে ৬.৫৬ টাকা করা হয়েছে।শিল্প গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেট ৮.৫৩ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.৯৬ টাকা, অফ পিকে ৭.৭৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.০৬ টাকা, পিকে ১০.২৪ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০.৭৫ টাকা করা হয়েছে। শিল্পে মধ্যমচাপে (১১ কেভি) ফ্ল্যাট রেটে ৮.৯৮ টাকা, অফ-পিকে ৮.০৯ টাকা এবং পিকে ১১.২২ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়েছে। উচ্চচাপ (৩৩ কেভি) গ্রাহকদের ফ্ল্যাট রেটে ৮.৮৭ টাকা, অফ-পিকে ৭.৯৯ টাকা এবং পিকে ১১.০৯ টাকা দর নির্ধারণ করা হয়েছে।শিক্ষা, ধর্মীয়, দাতব্য প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালে নিম্নচাপে ৩০ পয়সা বাড়িয়ে ৬.৩২ টাকা, রাস্তার বাতি ও পানির পাম্পে ৭.৭০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮.০৯ করা হয়েছে। বাণিজ্যিক ও অফিসের বর্তমান দর ফ্ল্যাট রেটে ১০.৮২ টাকা, অফ-পিকে ৯,৭৩ টাকা, পিকে ১২.৯৮ টাকা করা হয়েছে। অতি উচ্চচাপ (শিল্প) ২০ মেগাওয়াট থেকে ১৪০ মেগাওয়াট পর্যন্ত ফ্ল্যাট রেটে ৮.৭৮ টাকা, অফ-পিকে ৭.৯০ টাকা, পিকে ১০.৯৭ টাকা দর নির্ধারণ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।২০০৫ সালে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন গঠনের পর থেকেই বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করে আসছিল সংস্থাটি। গত ২১ নভেম্বর বিদ্যুতের পাইকারি দাম ইউনিট প্রতি ১৯.৯২ শতাংশ বাড়িয়ে ৬.২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তারপরই গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর আবেদন করে বিতরণ কোম্পানিগুলো। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বিইআরসি। গত ৮ জানুয়ারি শুনানি করে প্রায় গুছিয়ে এনেছিল নতুন দর ঘোষণার প্রস্তুতি। কিন্তু মাঝপথে বিইআরসিকে থামিয়ে নির্বাহী আদেশে দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।অতীতে কোম্পানি এবং গ্রাহকভেদে দরের ক্ষেত্রে কিছুটা তারতম্য দেখা গেলেও নির্বাহী সব বিতরণ কোম্পানির অভিন্ন দর দেওয়া হয়েছে। এতে কিছু কোম্পানির আয় ফুলে-ফেঁপে উঠবে। বিশেষ করে ডিপিডিসি ও ডেসকোর মধ্যে ধনিক শ্রেণির গ্রাহকদের কোম্পানিগুলো বিশেষ সুবিধা ভোগ করবে। অন্যদিকে প্রান্তিক এলাকায় গ্রাহকদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা হলেও চাপে পড়বে।ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেছেন, এভাবে তড়িঘড়ি করে দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা দেখি না। গণশুনানি নেওয়ার ৪ দিনের মাথায় নির্বাহী আদেশ দেওয়া উদ্বেগজনক। গণশুনানিতে দেখা গেছে বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রায় প্রত্যেকটিই মুনাফায় রয়েছে। তাহলে দাম বাড়িয়ে গ্রাহকদের চাপে ফেলার কী কারণ?বিইআরসির মাধ্যমে দাম সমন্বয় হলে কোম্পানিগুলোর একটি জবাবদিহিতার জায়গা ছিল। সেই জায়গাটিও বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এতে দুর্নীতি ও অনিয়ম আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির চলমান প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেওয়ায় কমিশনের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা নিশ্চিত করেছেন বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল।তিনি বলেছেন, আপাতত দাম বাড়ানোর চলমান প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে। রবিবার (১৫ জানুয়ারি) কমিশনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। স্থগিতের কোনো সময়সীমা থাকছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, আপাতত স্থগিত এটুকুই বলতে পারি। পরেরটা পরে বলতে পারব, এখনই মন্তব্য করা সম্ভব না।বিইআরসি ৮ জানুয়ারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির আইনি প্রক্রিয়া শুনানি গ্রহণ করে। ঠিক ৪ দিনের মাথায় (১২ জানুয়ারি) নির্বাহী আদেশে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। বিইআরসি প্রতিষ্ঠার পর নির্বাহী আদেশে এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর নজির নেই। সংশোধিত বিইআরসি আইন অনুযায়ী গণশুনানি পরবর্তী ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে সিদ্ধান্ত জানানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। অনির্দিষ্টকাল ঝুলিয়ে রাখার সুযোগ নেই। হয় দাম বাড়িয়ে দিতে, অথবা প্রস্তাব নাকচ করতে হবে। সে হিসেবে আরও কিছুটা সময় হাতে রয়েছে বিইআরসির।বিদ্যুতের পর নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দামও বাড়ানোর তোড়জোড় দেখা গেছে। গত জুন মাসেই গ্যাসের দাম বাড়ায়, সে হিসেবে ৬ মাসের মাথায় আরেক দফা গ্যাসের দাম বাড়াতে যাচ্ছে সরকার।জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব ড. মোঃ খায়েরুজ্জামান মজুমদার বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। তবে এখনো কিছুই চূড়ান্ত হয়নি। আমরা গ্যাসের সরবরাহ বাড়াতে চাই, এ জন্য আমদানি বাড়ানোর প্রয়োজন হবে। আমদানি বাড়াতে হলে খরচ বেড়ে যাবে, সে কারণে দাম বাড়ানোর বিষয়ে আলাপ আলোচনা চলছে। স্বস্তির খবর হচ্ছে স্পর্ট মার্কেটে এলএনজির দর কমতির দিকে রয়েছে।জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, চলতি সপ্তাহেই দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ দফায় শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে দাম বাড়তে পারে। আবাসিকের বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। শিল্পের বর্তমান দর ইউনিটপ্রতি ১১.৯৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২৫-৩০ টাকা করা হতে পারে। ব্যবসায়ী নেতাদের পরামর্শেই এমনটি করা হচ্ছে।ব্যবসায়ী নেতারা শিল্পে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ পেতে চান। চড়াদামে এলএনজি আমদানি করলে গ্যাসের দর বেড়ে যাবে। যে কারণে গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হলে দাম বাড়ানোর বিকল্প নেই। সরকারের এমন প্রস্তাবে ব্যবসায়ীদের অভিমত ছিল, তারা বাড়তি দামই দিতে রাজি আছেন। তাদের সেই প্রস্তাব কার্যকরের প্রক্রিয়া চলমান।পেট্রোবাংলার গত জুন মাসের হিসাব অনুযায়ী স্পর্ট মার্কেট থেকে আমদানি করা এলএনজির (ট্যাক্স-ভ্যাটসহ) ইউনিটপ্রতি ঘনমিটারের দর পড়েছিল ৪৬.৮৫ টাকা। বাপেক্স থেকে কেনা গ্যাস ৪.৫৪ টাকা, সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির দশমিক ৩৩ টাকা, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি দশমিক ৮৭ টাকা এবং আইওসির কাছ থেকে ২.৯০ টাকা। দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস আমদানি বিবেচনায় মিশ্রিত গ্যাসের মূল্য দাঁড়াবে ১৫.৩০ টাকা। অন্যান্য চার্জসহ গড়মূল্য ২০.৩৫ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়।বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটি তার হিসাবে বলেছিল, ২০১৯-২০ অর্থবছরে গড়ে দৈনিক ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি বিবেচনায় দর নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে গড়ে ২৯২ মিলিয়ন কম হয়েছে। এতে প্রতি ঘনমিটারে ২.৪০ টাকা হারে কমে মোট ব্যয় কমেছে ৭২ হাজার ৮৪৩ মিলিয়ন টাকা। একইভাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে দৈনিক গড়ে ৬৮৪.৮৪ মিলিয়ন এলএনজি বিবেচনায় মিশ্রিত ক্রয়মূল্য দাঁড়িয়েছে ১২.৪৭ টাকা।পরে আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের (এলএনজি) দাম বৃদ্ধির ধুয়া তুলে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বাড়িয়ে দেয় বিইআরসি। তখন সার উৎপাদনে ২৫৯ শতাংশ, শিল্পে ১১.৯৬ শতাংশ ( বৃহৎ শিল্পে ১১.৯৮ টাকা, মাঝারি শিল্পে ১১.৭৮ টাকা, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০.৭৮ টাকা, চা শিল্পে ১১.৯৩ টাকা), বিদ্যুতে ১২ শতাংশ, ক্যাপটিভে ১৫.৫ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়। আবাসিকে এক চুলার দর ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী আবাসিক গ্রাহকদের ইউনিটপ্রতি দর ১২.৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮ টাকা, সার উৎপাদনে ঘনমিটার ৪.৪৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৬ টাকা করা হয়।ওই দাম বাড়ানোর কিছুদিন পরেই স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ করে দেয় সরকার। এলএনজি আমদানি কমিয়ে দিলে বেড়ে যায় গ্যাস সংকট, এতে শিল্প মালিকদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হলে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা অবিলম্বে আত্মঘাতী