ভেস্তে গেল নির্বাচন কমিশনের (ইসি) দুই লাখ ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন কেনা। সঙ্গে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেড়শ আসনে ইভিএমে ভোট করার ইসির পরিকল্পনাও। অবশেষে হতাশ ইসি। কেনাকাটার একটা তুমুল উৎসব স্থগিত হলো।আর্থিক সংকটের কারণে প্রায় নয় হাজার কোটি টাকার ইভিএম প্রকল্পটি অনুমোদনের সুপারিশ করল না পরিকল্পনা কমিশন। তবে এখনো হাল ছাড়েনি ইসি। প্রয়োজনে কমিশন সভা করে প্রকল্পটির প্রস্তাবনা নিয়ে পর্যালোচনা করে আবার রিভিউডিপিপি পাঠাবে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আর্থিক সমস্যা নয়, বিরোধী দলের আপত্তিও সমস্যা না। ইসির নিজস্ব সক্ষমতার ঘাটতিই আসল সমস্যা। নিজেদের অক্ষমতা জানার পরও বিশাল কেনাকাটা যজ্ঞে হাল ছাড়েনি কমিশন। এগিয়েছে তুখোড় গতিতে। আলোচিত ছিল প্রকল্পে ৫৩৪টি ডাবল কেবিল কিআপ কেনা। ইভিএম নয় প্রয়োজন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন। ইসি সূত্র জানায়, পরিকল্পনা কমিশনের প্রশ্ন স্পষ্ট। তাদের প্রশ্নের সারসংক্ষেপ হচ্ছে, দেশে এখন ব্যবহার করা ইভিএমগুলো কেনা হয় ২০১৮ সালে। তখন প্রতিটির দাম পড়েছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার টাকা। তখন ভারতে ব্যবহৃত ইভিএমের দাম ছিল ১৭ হাজার রুপি। দামের এ বিশাল পার্থক্য অতি অস্বাভাবিক বলেছেন নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা। এর বিপরীতে ইসি বলছে, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়ায় ইভিএমে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম কেনার জন্য কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশনের দেওয়া প্রস্তাবে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পাস করেছিল জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। সেবার প্রতি ইভিএমের পেছনে ভ্যাট-ট্যাক্সসহ খরচ হয়েছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ফলে ইভিএমপ্রতি ১ লাখ টাকা থেকে দেড় লাখ টাকার মতো খরচ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নিজেদের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও দেড়শ আসনে এই মেশিনে আগামীতে ভোট নেওয়ার যাবতীয় প্রস্তুতি চলেছে। এখন অনেকটাই ভণ্ডুল পরিস্থিতি। কারণ ইসিরই ঘোষণা ছিল প্রকল্প অনুমোদন করাতে হবে মধ্য জানুয়ারির মধ্যেই। নইলে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া সম্ভব হবে না। ফলে বিষয়টি এখন ভণ্ডুলই বলা যায়।ইভিএম প্রকল্পে কার্যক্রমে ছিল, ২ লাখ ইভিএম কেনা, ৪ লাখ ব্যালট ইউনিট সংগ্রহ, ২ লাখ ডিসপ্লে ইউনিট সংগ্রহ, ১১টি ওয়েব সার্ভার, ২টি ডাটা সার্ভার, ১০ লাখ স্মার্ট কার্ড, ৫০টি স্মার্ট কার্ড রিডার, সাড়ে ৩ লাখ এসডি কার্ড রিডার, ২ লাখ প্লাস্টিক হার্ড বক্স ফর ইভিএম, ইভিএম কাস্টমাইজেশন সেন্টার স্থাপন, সাড়ে ৩ লাখ ইভিএম সংরক্ষণে ১০টি ওয়্যারহাউস স্থাপন, এক হাজার ৩০৩ জন জনবল নিয়োগ, ৬৪ জেলায় ভোটার শিখন কর্মশালা, ৫৩৪টি ডাবল কেবিল কিআপ, দুটি জিপ, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি, কম্পিউটার সফটওয়্যার, ভূমি ৪শ কাঠা কেনা। পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ব্যবহৃত ইভিএমে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি নেই। এর আগের বিভিন্ন নির্বাচনেও ইভিএমের বেশ কিছু দুর্বল দিক ধরা পড়েছে। সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট নেওয়া কেন্দ্রগুলোয় ভোট গ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ তুলেছেন বিজয়ী মেয়রও।এ ছাড়া বয়স্ক ও নারী ভোটারদের অনেকের আঙুলের ছাপ মিলছিল না। ইভিএমে ভোটারের পছন্দমতো প্রতীকে ভোট দিতে না পারার অভিযোগও ছিল অনেক। অধিকাংশ অভিযোগ ছিল, গোপন কক্ষে আগে থেকেই সরকারি দলের লোকজনের অবস্থান নিয়ে থাকা। ভোটার নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে ব্যালট ওপেন করার পর গোপন কক্ষে থাকা ব্যক্তি আগেই বাটন চেপে দেওয়ার মতো কেলেঙ্কারিও হয়েছে বহুবার।ইভিএম নিয়ে এত তীব্র সমালোচনা ও অনিয়মের পরও থামেনি কমিশন। ত্রুটি সারানো বা সক্ষমতা অর্জনের চেয়ে তাদের বেশি ব্যস্ততা চলেছে কেনাকাটায়। এটি নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। মেশিন চালানোর সামর্থ্য অর্জন না করে ২ লাখ ইভিএম কন্ট্রোল ইউনিট কেনা হবে। সঙ্গে চার লাখ ব্যালট ইউনিট ও ২ লাখ ডিসপ্লে মনিটর।আর এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে মোট ৬ হাজার ৬৬০ কোটি ২৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা, ২০৫ কোটি ৬৮ লাখ ৩২ হাজার টাকা যাবে জনসচেতনতায়, প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় খরচ ৬৯০ কোটি ৬৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা। আড়াই লাখ টাকার ব্যাটারি চার্জার এখন ৩০ লাখে।প্রকল্প অনুমোদন না পাওয়ার পর এক ব্রিফিংয়ে ইসি সচিব জাহাঙ্গীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, পরিকল্পনা কমিশন আমাদের জানিয়েছে, এ মুহূর্তে প্রকল্পটির কার্যক্রম প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে না; বাতিল নয়। পরিকল্পনা কমিশন রবিবার এক চিঠির মাধ্যমে ইসিকে এ বিষয়ে অবহিত করে।তিনি বলেন, কমিশন আগেই জানিয়েছেন নতুন প্রকল্প পাস না হলে আমাদের কাছে যত মেশিন আছে, তা দিয়ে যতগুলো আসনে করা সম্ভব ততগুলো আসনেই ভোট করব। এটা ৫০টিও হতে পারে, ৬০টিও হতে পারে, ৭০টিও হতে পারে। আমরা পরীক্ষা করে দেখব। যদি আর্থিক সামর্থ্য হয়, তাহলে ভবিষ্যতে হবে।ইভিএম নিয়ে বর্তমান কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আহসান হাবিব খান সম্প্রতি সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন, ইভিএম যেভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, চার্জ দিতে হবে, তার (পর্যাপ্ত যোগ্য) জনবল আমাদের নেই।এছাড়া সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া রংপুর সিটি করপোরেশন (রসিক) নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতির অভিযোগ পর্যালোচনা করেছে কমিশন। এ সমস্যা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, গত ১১ জানুয়ারি, ইভিএম ভোট গ্রহণে ধীরগতি বা স্লো হওয়ায় নির্বাচন কমিশনকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কেন ভোট বিলম্বিত হচ্ছে, এটা আমাদের খুব উদ্বিগ্ন করে তুলল। আলাপ-আলোচনা করে এগুলোকে যতটা ওভারকাম করা সম্ভব সেটি চেষ্টা করব। তিনি বলেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফিঙ্গার প্রিন্ট মিলছিল না। নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মো. আনিছুর রহমান বলেছেন, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) নতুন প্রকল্পের জন্য অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা করা হবে না। ফেব্রুয়ারি মাসেই ইভিএম ও ব্যালট পেপারে ভোট নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির ১ তারিখে কয়েকটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন আছে। তারপর বসে কতটি আসনে ব্যালট আর কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমাদের কাছে যে ইভিএম আছে সেগুলোর কিউসি করা হচ্ছে।এদিকে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান গত ১০ জানুয়ারি একনেক সভা শেষে বলেছিল, আমরা নিয়মকানুনের মধ্যেই ইভিএম নিয়ে কথা বলছি। নির্বাচন কমিশনের সব প্রয়োজন আইনের আলোকে বিচার করা হবে। তিনি বলেন, শুধু একনেক সভায় এগুলো অনুমোদন হয়, ব্যাপারটি তা নয়। তাদের (নির্বাচন কমিশন) সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। তাদের সচিবের সঙ্গে আমাদের সচিবের মধ্যে কথাবার্তা চলছে। ১৫ জানুয়ারি কোনো রেড লাইন (লাল রেখা) নয়, এটা ১৮ জানুয়ারিও হতে পারে, ২০ জানুয়ারিও হতে পারে। এমনকি আগামীকালও ইভিএম প্রকল্প অনুমোদন হতে পারে।বিরোধী পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এটি ভোট চুরির মেশিন। যদিও সরকার এবং নির্বাচন কমিশন এ ধরনের রাজনৈতিক অভিযোগ আমলেই নেয়নি কখনো।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও সুজন সম্পাদক অধ্যাপক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ইভিএম নয় প্রয়োজন সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন। তিনি ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীর অভিমত তুলে ধরে বলেন, ইভিএমে যে সুষ্ঠু ভোট হয় না এটা তো পরিষ্কার।আর যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রকে প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে যে কোনো ফল তৈরি করা সম্ভব। এটাতে পেপারটেল নেই। তাই নির্বাচন কমিশন যে তথ্য দেবে সেটাই আমাদেরকে গ্রহণ করতে হবে। তিনি বলেন, এটাতে ভোট হয় ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে, আর ভোট গণনার ফল হয় ম্যানুয়ালি।তিনি বলেন, দেশের নাগরিক সমাজ, সিংহভাগ রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ইভিএমের ব্যাপারে আপত্তি জানানোর পরও ইসির কেন এত অতিআগ্রহ। উদ্দেশ্যটা তাদের কী? এটা কি বাণিজ্য? নাকি এটার মাধ্যমে তারা ফল সৃষ্টি করতে পারবে, সেরকম ক্ষমতা? তিনি বলেন, আশা করব, সুষ্ঠু নির্বাচনের খাতিরে তারা ইভিএম থেকে সরে আসবে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য মনোযোগ দেবে।