আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ‘কার্যকর একটি আন্দোলন’ গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি। এজন্য টানা কর্মসূচি ঘোষণার পাশাপাশি নানা উদ্যোগও নিচ্ছে দলটি। জুলাই মাস থেকে বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত দাবিতে মাঠে কর্মসূচি নিয়ে আছে তারা।আগামী ৮ অক্টোবর থেকে টানা দুই মাসব্যাপী অর্থাৎ ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অভিন্ন কর্মসূচিতে যুগপৎ আন্দোলন গড়ে তুলতে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংলাপ শুরু হয়েছে গত ২ অক্টোবর থেকে। আন্দোলনের পর জয়লাভ করলে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের সিদ্ধান্তও আছে দলটির। এ ব্যাপারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রের যে ক্ষতি করেছে, তা উত্তরণ করা কোনো একক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন, নির্বাচনে যেসব দল অংশগ্রহণ করবে তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে। সেসব দলের কেউ যদি নির্বাচনে জয়লাভও না করে, তাহলেও সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে।’ তিনি বলেন, ‘এছাড়া আমরা নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মসূচি দিচ্ছি। এখন পর্যন্ত আন্দোলনে মানুষের সম্পৃক্ততা ব্যাপক আকারে বেড়েছে। এতে সরকার ভীত হয়ে আমাদের সমাবেশগুলোতে বাধা দিচ্ছে, টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করছে। কোথাও ছড়রা গুলি কিংবা গুলি করছে।’এতে এখন পর্যন্ত ৫ জন নিহত হওয়ার দাবি করেন তিনি। মির্জা ফখরুল বলেন, ‘ভোলায় ২ জন, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে ১ জন করে এবং যশোরে ১ জন নিহত হয়েছে।’ বিএনপি ২৮ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ বিভাগীয় পর্যায়ে গণসমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছে। তাতে দেখা যায়, আগামী ১০ ডিসেম্বরে মহাসমাবেশ করে ঢাকায় ব্যাপক শোডাউন করার পরিকল্পনা রয়েছে দলটির। তারা এর মাধ্যমে সরকারকে এই বার্তা দিতে চায় যে, নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার দাবি মেনে পদত্যাগ না করলে দুর্বার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের পদচ্যুত করা হবে। মূল আন্দোলন শুরু করার আগে এসব কর্মসূচিকে ‘রিহার্সেল’ বলে অভিহিত করছে বিএনপি। ঢাকার এই মহাসমাবেশ হবে আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ। তিনি বলেন, ঢাকার কর্মসূচি থেকেই আন্দোলনের নতুন কর্মসূচির ঘোষণা আসবে। ‘রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কারের’ রূপরেখা ঘোষণা করে বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচিও আসছে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে গত ২ অক্টোবর থেকে বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠক শুরু করেছে বিএনপি। এ মাসেই বৈঠকগুলো শেষ করে অভিন্ন দাবিতে সমন্বিত আন্দোলনের লক্ষ্য, ধরন ও কৌশল ঠিক করে আরও নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে। সেটা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত টেনে নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, ‘বিভাগীয় এসব সমাবেশের পর নতুন কর্মসূচি আরও আসবে।’ তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন আঙ্গিকে আমরা কর্মসূচি দেব। আমরা আগেও অনেকবার বলেছি- এই সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।’উল্লেখ্য, গত জুলাইয়ে সারা দেশে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হলে জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনার প্রতিবাদে জেলা পর্যায়ে কর্মসূচি দেয় বিএনপি। দলটির অভিযোগ, অধিকাংশ জায়গায় শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালিত হলেও বিভিন্ন জেলায় পুলিশ ও সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের বাধা ও হামলার শিকার হতে হয়। এর মধ্যে ৩১ জুলাই ভোলায় কর্মসূচিতে পুলিশ বাধা দেয় এবং একপর্যায়ে গুলি করে। গুলিতে স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী আবদুর রহিম মাতব্বর ও জেলা ছাত্রদলের সভাপতি নুরে আলম নিহত হন। পরদিন ১ আগস্ট থেকে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের পাশাপাশি দুই নেতা-কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদে লাগাতার কর্মসূচি শুরু করে বিএনপি। এর মধ্যেই ৬ আগস্ট ডিজেল, পেট্রলসহ জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক দাম বাড়ানো হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় সব জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এর প্রতিবাদে নতুন করে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ শুরু করে বিএনপি। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকায় অঞ্চলভিত্তিক আলাদা করে ১৬টি সমাবেশের ঘোষণা দেয় তারা। ১১ সেপ্টেম্বর থেকে গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৩টি সমাবেশ করেছে।বিএনপি দাবি করেছে, এর মধ্যে চারটিতে বাধা ও হামলার ঘটনা ঘটেছে। মিরপুরের পল্লবী, শ্যামপুর ও কামরাঙ্গীরচরের সমাবেশ কর্মসূচি এখনো বাকি আছে। মিরপুর জোনের যে কর্মসূচি পল্লবীতে হওয়ার কথা ছিল তা ৬ অক্টোবর হওয়ার কথা। এরই মধ্যে ১০ সাংগঠনিক বিভাগের জন্য নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি।বিভাগীয় পর্যায়ের কর্মসূচির মধ্যে ৮ অক্টোবর চট্টগ্রামে, ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহে, ২২ অক্টোবর খুলনায়, ২৯ অক্টোবর রংপুরে, ৫ নভেম্বর বরিশালে, ১২ নভেম্বর ফরিদপুরে, ১৯ নভেম্বর সিলেটে, ২৬ নভেম্বর কুমিল্লায়, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে এবং সবশেষে আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ হবে। এ ছাড়া ভোলা, নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সীগঞ্জে নিহত নেতা-কর্মীদের স্মরণে ৬ অক্টোবর সব মহানগরে এবং ১০ অক্টোবর সব জেলায় শোকর্যালি করবে বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, চাল, ডাল, জ্বালানি তেল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যবৃদ্ধি এবং ভোলায় নুরে আলম ও আবদুর রহিম, নারায়ণগঞ্জে শাওন প্রধান, মুন্সীগঞ্জে শহিদুল ইসলাম (শাওন) ও যশোরে আবদুল আলিমসহ দলের পাঁচ নেতাকর্মী নিহত হওয়ার প্রতিবাদে এই কর্মসূচি হবে।বিএনপি এসব কর্মসূচি সফল করার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে ইতোমধ্যে গঠন করা হয়েছে ১০টি শক্তিশালী টিম। সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্বাহী কমিটির সদস্য, সাবেক এমপি, সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকসহ জেলা নেতাদের রাখা হয়েছে এসব কমিটিতে। এসব কমিটির উপদেষ্টা হিসেবে থাকছেন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা। প্রতিটি বিভাগের গণসমাবেশকে মহাসমাবেশে রূপ দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে দলটির হাইকমান্ড। প্রস্তুতি পর্বের প্রতিটি মিটিংয়ে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিচ্ছেন স্বয়ং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।গত ১ অক্টোবর থেকে বিকেলে গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে বিভাগের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এতে সভাপতিত্ব করছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, চূড়ান্ত আন্দোলনের রিহার্সেল হিসেবে এসব সমাবেশে দলের সাংগঠনিক শক্তি জানান দেওয়া হবে। পাশাপাশি সরকারবিরোধী আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করাই এ কর্মসূচির অন্যতম লক্ষ্য।জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘এসব কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা জনমত গড়ে তুলতে চাই, জনগণকে সম্পৃক্ত করতে চাই। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলে প্রচণ্ড গণ-আন্দোলন সৃষ্টি করে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চাই।’ ফখরুল বলেন, ‘আমরা দেখছি আমাদের কর্মসূচিতে জনসম্পৃক্ততা বেড়েছে। আপনারা লক্ষ করেছেন যে, আমাদের সমাবেশগুলোতে যেটা ঢাকা শহরে হয়েছে, আগে জেলা-উপজেলায় হয়েছে সেখানে জনগণের সম্পৃক্ততা আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়েছে। আজকে বাংলাদেশের জনগণের মাঝে একটাই দাবি উপস্থিত হয়েছে যে, দিস গভর্মেন্ট মাস্ট গো।’