বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের কর্মকাণ্ড বিশেষ করে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যায়। দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩। এর মধ্যে ৪৯টিতেই উপাচার্য নিয়োগের কোনো নীতিমালা নেই। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠে আসে।ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগের আইন থাকলেও কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই সেই আইনের আলোকে ভিসি নিয়োগ করা হয়। নিয়োগে নীতিমালা না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় না। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনায় বিদ্যমান আইন ও বিধির কারণে উত্থাপিত অভিযোগের পরিপ্র্রেক্ষিতে যথাসময়ে ব্যবস্থা নিতে পারে না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)।এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য পরিষদের সাবেক সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. জসিমউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশের কেবল চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগে আইন রয়েছে। তবে অনেক সময় সেটিও সঠিকভাবে পালন করা হয় না। উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলোতে বিশেষভাবে জোর দেয়া দরকার তা অনেক ক্ষেত্রেই সঠিকভাবে করা হয় না।নিয়োগের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের গবেষণা কার্যক্রম মূল্যায়ন করার দরকার থাকলেও তা সেভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। এজন্য উপাচার্যদের ওপর যে একাডেমিক দায়িত্ব থাকে, অনেক ক্ষেত্রেই সেগুলো সঠিকভাবে পালন করা সম্ভব হয় না।বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ওয়ার্ল্ড র্যাংকিংয়ের এক হাজারের মধ্যেও স্থান না পাওয়া প্রসঙ্গে এক শিক্ষক বলেন, বাংলাদেশে গবেষণা কার্যক্রমকে সেভাবে মূল্য দেয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের গবেষণা কার্যক্রম সঠিকভাবে মূল্যায়ন হয় না বলে অনেক ক্ষেত্রেই নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি প্রাধান্য পায়। এ কারণে উপাচার্য নিয়োগের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে একাডেমিকসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক কার্যক্রমে।বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্নীতিসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও। গত মার্চে অনুষ্ঠিত বৈঠকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে উপাচার্যসহ ওপরের দিকের দুই বা তিনটি পদে নিয়োগ ছাড়া অন্য কার্যক্রমগুলো সাধারণত কর্তৃপক্ষ নিজেরাই করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম তদারকির জন্য ইউজিসি রয়েছে।সেই বৈঠকে ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসির কর্মকাণ্ড বিশেষ করে শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগের বিষয়ে বেশি দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। চারটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভিসি নিয়োগের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকার কারণে অনেক ক্ষেত্রে সঠিক ব্যক্তিকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয় না। যে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ আসছে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান আইন ও বিধির কারণে উত্থাপিত অভিযোগের পরিপ্র্রেক্ষিতে যথাসময়ে ব্যবস্থা নেয়াও সম্ভব হয় না।যে কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ ইউজিসি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সুপারিশ করার পরও অভিযুক্ত ভিসি প্রায় আট মাস ওই পদে বহাল ছিলেন। এমনকি শেষ কর্মদিবসে তিনি বিভিন্ন পদে অ্যাডহক ভিত্তিতে ১৩৮ জন জনবল নিয়োগ দিয়ে গিয়েছেন। তবে ইউজিসির বিদ্যমান আইনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম সম্পর্কে সরাসরি কোনো তদন্ত কমিটি গঠনের ক্ষমতা নেই।রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশনা দিলে সে ক্ষেত্রে এটা করা যেতে পারে।ওই বৈঠকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মো. আফছারুল আমীন বলেন, বিদ্যমান আইনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনিয়ম ও দুর্নীতি রোধে ইউজিসির কিছুটা সীমাবদ্ধতা থাকলেও সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বেশকিছু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে।বিদ্যমান আইনের মধ্যে থেকেই রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়টিতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।শিক্ষা খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়োগের জন্য রিজেন্ট বোর্ড আছে। সেই বোর্ডের সদস্য হচ্ছেন রাজনৈতিক নেতা এবং স্থানীয় সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের আমলা। নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের ইচ্ছা প্রাধান্য পায়। অভিযোগ আছে, তাদের কথামতো না চললে ওই জায়গায় কেউ দায়িত্ব পালন করতে পারে না। তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত রিজেন্ট বোর্ডে দেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদদের নিয়োগ দিলে তাদের মেধাভিত্তিক পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপকৃত হতে পারত।বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বঙ্গবন্ধুর করা অধ্যাদেশগুলোতে উপাচার্য নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচনের জন্য একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। যদিও পরবর্তী সময়ে সেটি আর অনুসৃত হয়নি। একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন যোগ্য উপাচার্য নির্বাচন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা করার সুযোগ রয়েছে। সেটি করা গেলে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এ পদটিতে যোগ্য ব্যক্তিই দায়িত্ব পাবেন।