দেশে বরাবরই চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন ও প্রাপ্তি বেশি। অন্যান্য খাদ্যপণ্যের মতো এ পণ্যটির উৎপাদন কখনো ব্যাহত হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, সাধারণত গড়ে সপ্তাহে একজন ডিম খায় দুইটি। এই হিসেবে এক বছরে মাথাপিছু ডিমের প্রয়োজন ১০৪টি। অথচ গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাথাপিছু ডিমের প্রাপ্তি ছিল ১৩৬টি। অর্থাৎ মাথাপিছু প্রাপ্তির চেয়েও ডিম বেশি থাকে আরো ৩৪টি। সার্বিকভাবে গত বছর ডিমের প্রাপ্তির কথা ছিল পাঁচ কোটি পিস। কিন্তু মিলেছে পাঁচ কোটি ৯০ লাখ। অর্থাৎ চাহিদার চেয়েও দেশে ডিমের উৎপাদন অনেক বেশি। চাহিদার চেয়ে বেশি প্রাপ্তি ও উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও এই খাদ্যপণ্যের দাম প্রতিনিয়ত বাড়ছেই। বিশ্লেষকরা ডিমের দাম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে বাজার সিন্ডিকেটকেই দোষারোপ করছেন।গত বছরে দেশে ডিমের মোট উৎপাদন হয়েছিল দুই হাজার ৩৩৫ কোটি পিস। চাহিদার তুলনায় ডিমের উৎপাদন বেশি হলে সাধারণত ডিমের দাম কম থাকার কথা। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে উল্টো-দফায় দফায় দাম বাড়তে বাড়তে ডিমের মূল্য এখন অনেক বেশি। ক্ষুদ্র খামারি ও ডিমের বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিমের উৎপাদন বেশি হওয়া সত্ত্বেও অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির পেছনে রয়েছে ডিম সিন্ডিকেটের হাত। এই ডিম সিন্ডিকেট প্রতিদিন সকালে নিজেরা একটি দাম নির্ধারণ করে দেয়। সেটি চার থেকে পাঁচটি হাত ঘুরে আসতেই ডিমের দাম বেড়ে যায় অনেকটা। একটি ডিমের উৎপাদন ব্যয় যেখানে এখন ৯ থেকে ৯ টাকা ৫০ পয়সা, সেখানে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৩ থেকে ১৪ টাকায়। অর্থাৎ একটি ডিমের উৎপাদন খরচ আর খুচরা বিক্রয়মূল্যের মধ্যে পার্থক্য ৪ থেকে ৫ টাকা, যা মোটেই সমীচীন নয় বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।এদিকে আজ বিশ্ব ডিম দিবস। প্রতি বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় শুক্রবার সারাবিশ্বে এই ডিম দিবস পালন হয়ে থাকে। প্রতি বছরের মতো এবারো বাংলাদেশে নানা অনুষ্ঠানের মধ্যে ডিম দিবসটি পালন করা হবে। এবারের ডিম দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘প্রতিদিন একটি ডিম, পুষ্টিময় সারা দিন’।প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন, ওয়ার্ল্ডস পোল্ট্রি সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে দিবসটি ঘিরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আজ শুক্রবার (১৪ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৯টায় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনের রাস্তা থেকে র্যালি বের হবে। র্যালি শেষে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে সেমিনার ও বিকালে রাজধানীর বসুন্ধরা করভেনশন হলে ডিমমেলা অনুষ্ঠিত হবে। উল্লেখ্য, ডিমের গুণাগুণ সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় প্রথম ‘বিশ্ব ডিম দিবস’ পালনের আয়োজন করে।দেশে ডিমের উৎপাদন ও প্রাপ্তি যেখানে চাহিদার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সেখানে দেশের মানুষের কম দামে ডিম পাওয়ার কথা। অথচ এখন একটি ডিমের দাম ১৩ থেকে ১৪ টাকা, এক হালি ডিমের দাম ৫৫ থেকে ৫৬ টাকা এবং ডজনের দাম পড়ে ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকা। এতো ডিম উৎপাদনের পরও দাম কেনো বেশি সে বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এর পেছনে মূল কারণ একটি অসাধু চক্রের সিন্ডিকেট।কথা হচ্ছে, ডিমের বাজারে সিন্ডিকেটটা কীভাবে কি করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চার থেকে পাঁচটি হাত বদলে এই পণ্য আসছে ভোক্তার কাছে। আর এই হাতবদলের সিন্ডিকেটেই বাড়ছে দাম। খামারি থেকে ডিম কেনে একশ্রেণির সরবরাহকারী বা এজেন্ট তাদের কাছ থেকে কেনে আড়তদাররা, তাদের কাছ থেকে ডিম যায় পাইকারি দোকানে, সেখান থেকে যায় খুচরা দোকানে। মুরগির খামারিদের কাছ থেকে আসা ডিম হাত বদলে প্রতিটিতে দাম দুই টাকার মতো বেড়ে যায়। তবে তার লাভ খানিকটাই পান বলে দাবি করছেন খামারিরা। আড়তদাররা বলছেন, মধ্যস্বত্বভোগী সরবরাহকারীরাই লাভ কুড়িয়ে নিচ্ছে। সরবরাহকারীরা আবার দুষছেন বড় কোম্পানিগুলোকে। বড় কোম্পানিগুলো আবার সেই অভিযোগ অস্বীকার করছে।এ বিষয়ে ক্ষুদ্র খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ‘ডিম সিন্ডিকেটের মূল হোতা করপোরেট কোম্পানিগুলো। তারা প্রতিদিন সকালে ডিমের দাম ঠিক করে দেয়। সে দামের হার ধরেই ডিলার, পাইকারিসহ সব পর্যায়ে দাম বাড়তে বাড়তে ভোক্তার হাতে গিয়ে যখন পড়ে তখন একটি ডিমের দাম ১৩ থেকে ১৪ টাকা হয়ে যায়। এই সিন্ডিকেট না ভাঙা পর্যন্ত ডিম ও মুরগির দাম কমবে না। তাছাড়া আমরা দীর্ঘ দিন সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি, এই সিন্ডিকেট ভাঙার জন্য সরকারকে একটি পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করে দিতে। এই বোর্ড ডিম, ব্রয়লার মুরগি, এক দিনের বাচ্চা এবং পোল্ট্রি খাদ্যের দাম ঠিক করে দেবে। সে দামেই সারা দেশে বিক্রি হবে। তাহলে এই সিন্ডিকেট ভাঙা সম্ভব হবে।’
ডিমের পুষ্টিগুণ
একটি ডিমে শক্তি থাকে ১৪৩ ক্যালোরি, কার্বোহাইড্রেট ০.৭২ গ্রাম, প্রোটিন ১২.৫৬ গ্রাম, ফ্যাট ৯.৫১ গ্রাম, ফসফরাস ১৯৮ মিলিগ্রাম,পটাশিয়াম ১৩৮ মিলিগ্রাম, জিঙ্ক ১.২৯ মিলিগ্রাম। এছাড়াও ডিমের কুসুমে থাকে ভালো ফ্যাট এবং আয়রন ও ভিটামিন। সাদা অংশে থাকে প্রোটিন। শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি, হাড় শক্ত করতে ও মেধা বিকাশে ডিম খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ডিমে আরো রয়েছে ভিটামিন ‘এ’, যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। কুসুমে থাকে ভিটামিন ‘ডি’, যা হাড় গঠনে কাজে লাগে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে অপুষ্টি, রক্তাল্পতা ও ডায়াবেটিসের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে প্রতিদিন অন্তত একটি ডিম খাওয়া উচিত।