আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া শর্ত অনুযায়ী ব্যাংকের ঋণের সুদের উপরিসীমা কয়েকটি খাতে বৃদ্ধিসহ বেশ কিছু বিষয়ে চূড়ান্ত হয়েছে। অন্যন্যা শর্তের মধ্যে রয়েছে। অর্থনীতিতে ভর্তুকির বোঝা কমানো, খেলাপিঋণ কমিয়ে আনা, রিজার্ভের হিসাবের পদ্ধতিতে পরিবর্তন, সরকারের ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, অর্থনৈতিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।আজ মঙ্গলবার (৮ নভেম্বর) অর্থসচিব ফাতিমা ইয়াসমিন ও আগামীকাল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে সমাপনী বৈঠকের মধ্য দিয়ে আইএমএফ প্রতিনিধিদের সফর শেষ হবে।সফর শেষে প্রতিনিধি দল আইএমএফের বোর্ড সভায় শর্ত সংবলিত একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করবে। বোর্ড সভায় অনুমোদন পেলে ঋণ পাওয়া যাবে। তবে তিন বছরের জন্য মোট ঋণের ৪৫০ কোটি ডলারের মধ্যে প্রথম দফায় প্রথম কিস্তির ঋণ পাওয়া যাবে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।আইএমএফ প্রতিনিধি দল গত ২৬ অক্টোবর ১৫ দিনের বাংলাদেশে সফরে আসে। অর্থ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিডাসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলাদাভাবে বৈঠক করেছে। এই সিরিজ বৈঠকের মধ্য দিয়ে আইএমএফ একগুচ্ছ শর্ত দিয়েছে।এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, ঋণের সুদের হারের উপরিভাগের সীমা তুলে নেওয়া। যা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা হয়েছে। এই বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পরামর্শ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে।ঋণের সুদের হার উপরিভাগ বাড়ানোর ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের আপত্তি থাকলেও অবশেষে আইএমএফের ঋণের জন্য সরকার ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার চাপ কমাতে আইএমএফের ঋণ এখন অনিবার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে অর্থ বিভাগের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।এ দিকে আইএমএফের বেশ কিছু শর্ত সরকারের কাছে স্পর্শকাতর মনে হচ্ছে। এর মধ্যে হচ্ছে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি। ভর্তুকি কমিয়ে আনতেই এই প্রস্তাব করা হয়েছে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যেতে পারে। এই আশঙ্কায় সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি এখন ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করার পক্ষে মত দেওয়া হয়েছে।অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরে বাজেটে মোট ৮২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা ভর্তুকি বাবদ রাখা হয়েছে।এর মধ্যে বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সার, কৃষি অন্যতম। সারে ভর্তুকি আপাতত কমানো সম্ভব নয় বলে বিভিন্ন যুক্তি দিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া বিষয়টি সরকারের কাছে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও গুরত্বপূর্ণ বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থবিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছে।বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আইএমএফ ঋণের উপরিভাগ সুদের হার বাড়ানোর ব্যাপারে যে শর্ত দিয়েছে তা আপাতত মেনে নেওয়া হতে পারে।বর্তমানে ঋণের হার উপরিভাগের সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের পাশাপাশি কয়েকটি খাতে ১২ শতাংশে করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। তবে সব খাতের জন্য না হলেও কয়েকটি খাতের জন্য বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হতে পারে। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের হিসাব কিছুটা পরিবর্তন করা হতে পারে।বাংলাদেশ ব্যাংকের দেখানো ৩৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বিনিয়োগ করা প্রায় সাড়ে আট বিলিয়ন ডলার বাদ দিতে হবে। আর বাদ দিয়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দেখাতে হবে। ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপি কমানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক আইএমএফের শর্তের ব্যাপারে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে।আইএমএফের বাংলাদেশের কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক হার কমানোর ব্যাপারে প্রস্তাবে সরকারের পক্ষ থেকে নমনীয় মনোভাব দেখানো হয়েছে। বর্তমান ট্যারিফ হার বেশি বলে মনে করছে আইএমএফ। রাজস্ব বাড়াতে করের আওতা একদিকে যেমন বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। তেমনি করের হার বৃদ্ধির কথাও এসেছে আইএমএফের কাছ থেকে।এই দুটো ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি উঠেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।পুঁজিবাজার সংস্কার আর্থিক সংস্কারের একটি গুরত্বপূর্ণ অংশ। সরকারের ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ব্যাপারটিও আর্থিক খাতের আরও একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। যে কারণে আইএমএফের এই শর্ত নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তেমন কোনো আপত্তি উঠেনি। বরং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই কার্যক্রম চলমান।চলতি বছরের ২৪ জুলাই লেনদেনে ভারসাম্য, বাজেট সহায়তা ও অবকাঠামো খাতের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে আইএমএফের কাছে সরকারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানো হয়।পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের বার্ষিক বোর্ড সভার এক ফাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার আইএমএফের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে ঋণ পাওয়ার বিষয়টি মৌখিকভাবে আশ্বাস পাওয়া যায়। সেই আশ্বাসের প্রেক্ষিতে আনুষ্ঠানিক আলোচনার জন্য আইএমএফের দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বে ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল গত ২৬ অক্টোবর ঢাকায় আসে।ঢাকায় প্রতিনিধি দল খুবই ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে সময় কাটায়। কাল ৯ নভেম্বর তাদের ঢাকা ত্যাগ করার কথা।