বর্তমানে ইন্টারনেট যুগে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ার পাঠক অনেকটাই কমেছে। তবু দেশের বিভিন্ন জায়গায় হাজারো বইয়ের সংগ্রহ গড়ে পাঠকদের মনের ক্ষুধা মেটানোর পাশাপাশি বই পড়ার প্রবণতা বাড়াতে কাজ করছে পাবলিক লাইব্রেরিগুলো।
সাভারে এক সময় মানুষের অবসর সময় কাটতো পাবলিক লাইব্রেরীতে বসে বই কিংবা খবরের কাগজ পড়ে। কিন্তু প্রায় ২০ বছর ধরে সে সুযোগ থেকে ধীরে ধীরে বঞ্চিত হয়েছে সাভারবাসি। একটি মাত্র পাবলিক লাইব্রেরিতে সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিচালনা করছেন রাজনৈতিক এক নেতা। তিনি প্রয়োজন হলে তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করেন। প্রয়োজন শেষ হলে আবার দরজায় লাগানো হয় তালা। ফলে পাঠক শ্রেণীর মানুষ বাধ্য হয়ে আড্ডা দিচ্ছেন চায়ের দোকানে।উল্লেখ্য,১৯৩৯ সালে রাখাল চন্দ্র মেমেরিয়াল হল নামে এই লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পর বেশ কয়েক যুগ পাঠকরা তাদের মনের খোরাক পেয়েছেন এখানেই। মানুষ অবসর সময় পেলেই ছুটে আসতেন লাইব্রেরীতে। তবে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী পাঠাগারের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে পাঠকশূণ্য হয়ে পড়েছে এই পাবলিক লাইব্রেরী। এটিই নিজের ব্যক্তিগত অফিস হিসাবে বর্তমানে ব্যবহারও করছেন তিনি।সরেজমিনে জানা যায়, সাভার সরকারি কলেজের পাশে অবস্থিত ওই লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকের ওপরে লাগানো রয়েছে পাবলিক লাইব্রেরি নামে বিশাল সাইনবোর্ড। ভেতরে দেয়াল ও শোকেসে সারি সারি বইয়ের দেখা মিললেও পাওয়া যায়নি কোনও পাঠক।তবে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী ওই পাবলিক লাইব্রেরিটি ব্যবহার করছেন নিজের ইচ্ছামত। মাঝে মধ্যে লাইব্রেরিতে বসে ব্যক্তিগত কাজ সম্পাদন করতে দেখা যায় তাকে। ভিতরে গ্লাসের বেষ্টনীতে আলাদা কেবিন। নামে লাইব্রেরীর অফিস কক্ষ হলেও এটিতে মুলত বসে রাজনৈতিকসহ ব্যক্তিগত কাজ করে চলেছেন তিনি। এই লাইব্রেরীতেই চলে রাজনৈতিক ভোজ, বিচার কার্য থেকে শুরু করে নানা ধরনের কাজ। ফলে পাঠক লাইব্রেরীতে না আসায় ধুলোর আস্তর পড়েছে বইয়ে।সাভার সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জিসান অভিযোগ করেন, কলেজের পাশেই অবস্থিত পাবলিক লাইব্রেরি। আমি একবার বই পড়তে সেখানে গিয়েছিলাম। ভেতরে অনুষ্ঠান চলায় আর প্রবেশ না করেই ফিরে আসি। এর পর আর কখনও যাওয়া হয়নি।সাভার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মাসুদ চৌধুরী পাবলিক লাইব্রেরী ব্যক্তিগত অফিস বানিয়ে ফেলেছেন। সেখানে বসেই বিচার কাজ থেকে রাজনৈতিক সকল কাজ করে থাকেন তিনি। ফলে সেখানে বই পড়তে যাওয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারন মানুষ রাজনৈতিক নেতাকে এমনিতেই একটু বড় মাপের মানুষ ভেবে তাদের কাছে কম যেতে চান। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে তো অনেকেই ভয় পান। অনেকে ইতস্তত বোধ করেও যেতে চান না।স্থানীয় সালাম বলেন, পাবলিক লাইব্রেরী থাকলেও সেখানে বসে জ্ঞান চর্চা করা যায় না। বইও ছিল অনেক, কিন্তু লাইব্রেরী থাকে তালাবদ্ধ অবস্থায়। সেখানে যাওয়ার তো কোন পরিবেশ নেই। এখানে সাধারণ সম্পাদক বসেন। জেলা পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা তিনি, তার আশে পাশে নেতাকর্মী থাকেন সবসময়। একারনে অনেকেই লাইব্রেরীতে যায় না। আমি নিজেও যাই না।
এব্যাপারে সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রতন পিটার গমেজ বলেন, সাভার পাবলিক লাইব্রেরি এক সময় স্কুলেরই ছিল। এটা পাবলিক লাইব্রেরি জনগণের জন্য। সেখানে সবাই যাবে, বই পড়বে। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপ আলোচনা করবে। স্বর্গীয় রাখাল চন্দ্র সাহা সাভারে এটিসহ তিনটি প্রতিষ্ঠান একসাথে করেছেন। অধরচন্দ্র সরকারি হাইস্কুল, রাখাল চন্দ্র পাবলিক লাইব্রেরি ও তারাপুরের খেলার মাঠ। পরবর্তীতে স্থানীয়রা এটা কি হিসাবে কি করছে তারাই ভাল জানেন। পাবলিক লাইব্রেরী ব্যক্তিগত অফিস বানিয়ে রাজনৈতিক ও বিচারকাজ সম্পাদনের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা আসলে হওয়ার কথা না। এটা যে উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে সেটাই করা উচিৎ। এটার তো এখন সভাপতি ইউএনও, তবে রাজনৈতিক অফিস করে নেওয়ার ব্যাপারে কোন মন্তব্য করবো না।সাভার উপজেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারন সম্পাদক স্মরণ সাহা বলেন, পাবলিক লাইব্রেরীটি সকলের জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হোক। যাতে সকল শিক্ষার্থী শিক্ষানুরাগীরা জ্ঞান চর্চা করতে পারেন।এব্যাপারে অভিযুক্ত লাইব্রেরীর সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদ চৌধুরী বলেন, এটি রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। তবে এই লাইব্রেরীতে রাজনৈতিক কর্মকান্ডের কথা স্বীকার করলেও এর কোন প্রভাব শিক্ষার্থীদের ওপর পড়ে না বলে দাবি করেন তিনি। তিনি বলেন, এখান থেকে করোনার সময় খাদ্য দ্রব্য বিতরণ করা হয়েছে। গত পৌরসভা নির্বাচনে ১২ দিন ১ ঘন্টা করে এটি ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনেও এটি তিন থেকে ৪ দিনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু দুই একটা মিলাদ ছাড়া এখানে কোন মিটিং করা হয় নি। নদী রক্ষা কমিটি এখানে মিটিং করেছে। তবে এসব কিছুর প্রভাব পাঠকদের ওপর পড়ে না। এটাতে আগে জুয়া খেলা হতো সেটা এখন। এখন তো এটার একটা পরিবেশ রয়েছে।বিষয়টি নিয়ে লাইব্রেরীর সভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বলেন, পাবলিক লাইব্রেরী যে ভবনে স্থাপিত সেটি জরাজীর্ণ এবং প্রায় ব্যবহার অনুপযোগী। বিভিন্ন সময় এটি সংস্কার করে ব্যবহার করা হয়। এখানে কোন রাজনৈতিক ব্যাক্তির কার্যালয় রয়েছে বলে আমার জানা নাই। বিষয়টি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছেই প্রথম জানলাম। এমনটা যদি হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা চেষ্টা করছি যাতে পাঠকরা এখানে আসেন এবং প্রকৃত অর্থে ব্যবহার করেন। যার মাধ্যমে একটি সাহিত্য সমৃদ্ধ সমাজ গঠন হতে পারে।