মূল্যবোধ হলো এমন একটি বিষয় যা প্রতিটি মানুষ শৈশবকাল থেকেই দীর্ঘদিনের আচার আচরণ, বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে অর্জন করে থাকে। পরিবার হলো শিশুর মুল্যবোধ শিক্ষা অর্জনের ভিত্তি। পারিবারিক গণ্ডির বাইরে শিশুর মূল্যবোধ বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয় বিদ্যালয়ে এসে।
পরিবার ও বিদ্যালয়ের মূল্যবোধের চর্চা শিশুর পরবর্তী জীবনের আদর্শবান, দেশপ্রেমিক ও বিশ্বনাগরিক হয়ে গড়ে ওঠার প্রেরণা যোগায়। জাতীয় শিক্ষাক্রমের রূপকল্পটি হলো “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত দেশপ্রেমিক, উৎপাদনমুখী, অভিযোজনে সক্ষম ও সুখী বৈশ্বিক নাগরিক”। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ এর রূপকল্পটিতে শিশুকে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভুদ্ধ, জাতীয় ইতিহাস সংস্কৃতি লালনকারী সৎ, নৈতিক, মূল্যবোধসম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, দক্ষ, সৃজনশীল, আত্ববিশ্বাসী ও সুখি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখা হয়েছে।
প্রাথমিক স্তর থেকেই শিশুর মধ্যে মূল্যবোধ চর্চার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাঠ্যবইয়ের বিষয়সমূহের মধ্যে মূল্যবোধ অর্জনে সহায়ক ঘটনা, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি সংযোজন করা হয়েছে। শ্রেণিতে শিশু শুধুমাত্র জ্ঞানই অর্জন করবে না তার পাশাপাশি মূল্যবোধ অর্জনে সহায়ক কার্যাবলীও পাঠপরিকল্পনায় বাধ্যতামূলকভাবে রাখতে বলা হয়েছে। বর্তমান শিক্ষাক্রমটি নির্দিষ্ট যোগ্যাতার আলোকে এমনভাবে পরিমার্জিত করা হয়েছে যেখানে একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় শিশু অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধের সর্বোত্তম প্রয়োগ ঘটাতে সক্ষম হবে।
এখানে উদাহরণসরূপ বলা যায়, একটি গাড়ি কিভাবে চালাতে হয় তা যখন বই পড়ে, দেখে বা শুনে একজন শিক্ষার্থী জানতে পারে তখন তার জ্ঞান অর্জিত হয়। ঐ শিক্ষার্থী যখন গাড়ির বিভিন্ন যন্ত্রাংশগুলো হাতে কলমে পরিচালনা করতে শিখে অর্থাৎ গাড়ি যখন সামনে পেছেনে ডানে বামে চালাতে পারে, ব্রেক করতে পারে তখন তার দক্ষতা অর্জিত হয়। আর যখন চালিয়ে নিজের ও রাস্তার সকল মানুষ, প্রানী ও সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে তখন ঐ শিক্ষার্থীর গাড়ি চালনা বিষয়ে যোগ্যতা অর্জিত হয়। এভাবে বর্তমান পরিমার্জিত শিক্ষক্রম ২০২১ এর মাধ্যমে শিশু জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি মূল্যবোধ চর্চার মাধ্যমে বাস্তব জীবনে প্রয়োজনীয় প্রেক্ষাপটে প্রয়োগে সক্ষম হবে বলে আশা করা যায়। বর্তমান পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমে তাই যোগ্যতার চারটি উপাদান হিসেবে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি মূল্যবোধকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে যোগ্যতার ধারণায়নের প্রেরণা হিসেবে উপলব্ধি ও অনুধাবন করে জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও গুণাবলী এই চারটি উপাদানের মধ্যে নিবিড় আন্তঃসম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে যোগ্যতার ধারণাকে এই শিক্ষাক্রমে ব্যবহার করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমের রূপকল্প, অভিলক্ষ্য, ১০টি মূলনীতি, ১০টি মূলযোগ্যতা, ১০টি শিখনক্ষেত্র, বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা, প্রাথমিক স্তরের শিখনক্ষেত্রভিত্তিক যোগ্যতা প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল্যবোধের বিষয়টি বিশেষভাবে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে।
শিক্ষাক্রমে মূল্যবোধ চর্চার জন্য যে বিষয়গুলো প্রাধান্য দেয়া হয়েছে সেগুলো হলোঃ সংহতি, দেশপ্রেম, সম্প্রীতি, পরমতসহিষ্ণুতা, শ্রদ্ধা/সম্মান, শুদ্ধাচার। প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা সমাপনান্তে শিক্ষার্থীর মধ্যে যেসব মানবিক গুণাবলী প্রত্যাশা করা হয়েছে সেগুলো হলোঃ সততা, পরিশ্রমী, গণতান্ত্রিক, অসম্প্রদায়িক, উদ্যোগী, ইতিবাচক, নান্দনিক, মানবিক, দায়িত্বশীল ও সহমর্মিতা।
এছাড়া শিক্ষাক্রমে পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিক্ষার্থীর কাঙ্খিত দক্ষতার ক্ষেত্র উল্লেখ করা হয়েছে। শিক্ষাক্রমে দক্ষতা হচ্ছে যোগ্যতার সামগ্রীক ধারণার অংশ যেখানে জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ইত্যাদির অর্জন পারস্পরিক নির্ভরশীল। যেমন: জ্ঞান অর্জনের জন্য জ্ঞানগত দক্ষতার প্রয়োজন আবার মূল্যবোধ চর্চার জন্য মনোসামাজিক ও আবেগীক দক্ষতার প্রয়োজন। একইভাবে ব্যবহারিক দক্ষতা বা আবেগীয় দক্ষতা অর্জনের জন্য জ্ঞান অর্জন এবং মূল্যবোধ চর্চা জরূরী। বর্তমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়ে প্রযুক্তির জ্ঞান শিক্ষার্থীর জন্য যতটা প্রয়োজন সেই সাথে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধের চেতনা গড়ে তোলাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থী মূল্যবোধ অর্জনের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে অভিযোজনে সক্ষম হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ভবিষ্যতের দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আত্বপ্রকাশ করবে এটা আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি।
আফসরী খানম
প্রধান শিক্ষক
গোহালাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়