আগামী নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার নিয়ে বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের আপত্তি চরমে। অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে প্রায় দুই লাখ ইভিএম কেনা। আর আগেরগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতে নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কাছে প্রস্তাব পাঠানোর প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশন।
দেড় লাখের প্রায় ৩০ শতাংশের ব্যাটারিসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রাংশ রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। এই দুর্যোগের সময়, তারপরও নির্বাচন কমিশন (ইসি) দেড়শ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের এই একরোখা সিদ্ধান্তে আপত্তি জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্ট জ্যেষ্ঠ নাগরিক সমাজ। ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি প্রয়াত অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। তারা বলছেন, ইসির এ সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক। এটি রাজনৈতিক বিতর্ককে আরও উসকে দেবে এবং কমিশনের বর্তমান আস্থার সংকটকে আরও প্রকট করে তুলবে। আমরা আবারও একটি ব্যর্থ নির্বাচনের কবলে পড়ব। যা জাতি হিসেবে চরম সংকটের দিকে ধাবিত করবে।
জানা গেছে, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা ও ভোটারদের আস্থাহীনতার কারণে পৃথিবীর অনেক দেশই এখন ইভিএম ব্যবহার থেকে সরে আসছে। প্রযুক্তির দিক থেকে অনেক উন্নত জার্মানি, ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছে। পৃথিবীর ১৭৮টির মধ্যে বর্তমানে শুধু ১৩টি দেশ ইভিএম ব্যবহার করে। কমিশনের সিদ্ধান্তের অযৌক্তিকতার একটি কারণ হলো, প্রযুক্তিগতভাবে ইভিএম একটি দুর্বল যন্ত্র। এতে ‘ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল’ (ভিভিপিএটি) নেই, যার ফলে কমিশন ভোটের যে ফল ঘোষণা করবে তা-ই চূড়ান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। এটি পুনর্গণনা বা নিরীক্ষা করার সুযোগ থাকবে না। এ কারণেই কমিশন কর্তৃক গঠিত কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারম্যান প্রয়াত জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৮ সালে ইভিএম কেনার সুপারিশে স্বাক্ষর করেননি।
এদিকে ইসির সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেড় লাখ ইভিএমের মধ্যে প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরিতে রয়েছে ৫৪ হাজারেরও বেশি ইভিএম। আর ৯৩ হাজারেরও বেশি রয়েছে মাঠ পর্যায়ে নির্বাচনের কাজে। কিছু ইভিএম নির্বাচন ভবনে সংরক্ষিত রয়েছে। সংরক্ষণের পর্যাপ্ত সুবিধার অভাব, গত পাঁচ বছর ধরে ব্যবহারের ফলে ব্যাটারি, চার্জিং কেবলের মতো যন্ত্রাংশের রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজন পড়ছে। এর হার প্রায় ৩০ শতাংশ। মাঠ পর্যায়ে থাকা ইভিএমের মধ্যে ৪৭ হাজার ইভিএম হার্ডবোর্ডের বাক্সে, ৪৫ হাজার ইভিএম কাগজের বাক্সে রয়েছে। হার্ড বাক্সগুলো সবগুলো পৌঁছায়নি। কাগজের বাক্সগুলো অত ভালো থাকে না। দেড় লাখ মেশিনই হার্ডবাক্সে থাকবে। কিন্তু হার্ডবাক্স পাঠানো হয়নি। একই সঙ্গে সংরক্ষণে রাখলে যেখানে রাখুক কোনোভাবে আর কিছু হবে না। ২০১৮ সালে শুরু ৩ হাজার ৮২৫ কোটির এ প্রকল্পের আওতায় একাদশ সংসদ নির্বাচনের ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়। আর দেশের প্রায় ৩০টি জেলায় বাসা-বাড়িতে স্টোরহাউস হিসেবে ব্যবহার করে ইভিএমগুলো রাখা হচ্ছে। কারণ ওয়্যারহাউস এখনো তৈরি করা হয়নি।
অন্যদিকে ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, কোথাও কোনো ইভিএম চুরি হয়নি বা হারিয়ে যায়নি। তবে একটি জায়গায় অগ্নিকা-ের পর আগুন নেভাতে গিয়ে পানি ঢুকে ৫০টির মতো ইভিএম নষ্ট হয়েছে। কয়েকটি জায়গায় মনিটর ও ব্যাটারি চুরির ঘটনা ঘটেছে।
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সাবেক সচিব এম হাফিজ উদ্দিন খান, সদ্য প্রয়াত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সচিব ড. আকবর আলি খান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল মতিন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেনসহ ৩৯ বিশিষ্ট নাগরিক বলছেন, প্রযুক্তির কারণে ইভিএম ব্যবহার করে ডিজিটাল জালিয়াতিও করা যায়। বায়োমেট্রিক্স ভিত্তিক ইভিএম অনেক ভোটারকেই শনাক্ত করতে পারে না। ফলে কমিশন প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদেরকে তাদের আঙুলের ছাপ দিয়ে যন্ত্রটি খুলে দেওয়ার তথা ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমের ফল নিয়েও কারসাজি করা যায়। এছাড়া নির্বাচনের সময়ে মাঠ পর্যায়ে নিয়োজিত কারিগরি টিমও নির্বাচনী ফল বদলে দিতে পারেন। গত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অন্তত দুবার ফল প্রকাশের অভিযোগ উঠেছে। যা কেবল ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমেই সম্ভব। এ ছাড়াও আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ইভিএম ব্যবহার করার কারণে ভোটাররা তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ইভিএম নিয়ে সুজনের বিশ্লেষণ হলো, এখানে ভোটার ভেরিফাইড পেপার অডিট ট্রেইল নেই, কর্মকর্তাদের ইভিএমকে ওভাররাইড করার ক্ষমতা, ইন্টিগ্রেটেড রেজাল্ট তৈরির সুযোগ নেই; ভোটদান ডিজিটাল, কিন্তুফল তৈরি ম্যানুয়াল, অন্য যে কোনো ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রের মতো প্রোগ্রামিংয়ের মাধ্যমে ইভিএমকে প্রস্তুত করতে হয়, নির্বাচন কমিশনের কারিগরি টিম ভোটের ফলও পাল্টে দিতে পারে। একটি কেন্দ্রের সব বুথের মাস্টার ডেটাবেজ নেই, ইন্টারনেট সংযুক্ত না থাকলেও দূর থেকে ইভিএম নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বায়োমেট্রিকভিত্তিক ইভিএম নাগরিকদের ভোটাধিকার হরণ করে, এটি একটি ব্ল্যাকবক্স, যার স্বচ্ছতা নিয়ে জনমনে সন্দেহ থাকে। এটি ব্যয়বহুল, যা আমাদের দেশের জন্য উপযোগী নয়। তাছাড়া নিখুঁত এনআইডি এবং বায়োমেট্রিক তথ্যভাণ্ডার এখনো তৈরি হয়নি।
বুয়েটসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলবিদরা বলছেন, ড. অ্যালেক্স হালডারমেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে ইভিএমের উপর গবেষণা করে প্রমাণ পেয়েছেন, আমেরিকায় ইভিএম টেম্পারপ্রুফ নয়। এ কারণে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যেও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ২২টির বেশি অঙ্গরাজ্যে ইভিএম নিষিদ্ধ। আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসও ইভিএম ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। জার্মানি ও ফিনল্যান্ডে আদালতের নির্দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে ইভিএম। পৃথিবীর ৯০ শতাংশ দেশে ইভিএম পদ্ধতি নেই। ২০০৬ সালে আয়ারল্যান্ড ই-ভোটিং পরিত্যাগ করেছে। ২০০৯ সালের মার্চ মাসে জার্মানির ফেডারেল ভোট ইভিএমকে অসাংবিধানিক ঘোষণা দেয়। ২০০৯ সালে ফিনল্যান্ডের সুপ্রিম কোর্ট তিনটি মিউনিসিপ্যাল নির্বাচনের ফল অগ্রহণযোগ্য বলে ঘোষণা করেন।
ইভিএমের ব্যাপারে সুজন সম্পাদক ও নির্বাচন বিশ্লেষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, যেহেতু ইভিএম ইন্টারনেটের সঙ্গে সংযুক্ত নয়, এর সফটওয়্যারের সোর্সকোড অন্য কারও কাছে নেই এবং এটি সম্পূর্ণরূপে নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে, তাই এটি দিয়ে বাইরের কারও পক্ষে কারচুপি করা প্রায় অসম্ভব। যদিও কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের পক্ষে কমিশনের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে কমিশনের ইন্টারনেটে ম্যালওয়্যার ঢুকিয়ে অন্য কম্পিউটার থেকে ইভিএমের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া সম্ভব। আমরা আরও বলেছি যে, বর্তমান ইভিএম কারিগরি দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল একটি যন্ত্র। এমনকি সম্প্রতি সাবেক সিইসি কেএম নূরুল হুদাও ইভিএমে কিছু ত্রুটি থাকার কথা স্বীকার করেছেন। আর এই ত্রুটিকে কাজে লাগিয়ে কমিশনের এবং তাদের অধস্তন কর্মকর্তা, কারিগরি টিম এবং নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করা ব্যক্তিদের পক্ষেই এ যন্ত্রটি দিয়ে নির্বাচনে কারসাজি করা সম্ভব।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ইভিএম কোনো দুর্বল যন্ত্র নয়। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট করার আর ১৫০টি আসনে ব্যালটে ভোট করার। এটা ইসির সিদ্ধান্ত। তার মতে, রাজনৈতিক অঙ্গনে যে সংকট দেখছি তা ইভিএম নিয়ে নয়। এই সংকট আরও মোটা দাগের।